প্রশান্ত বারিক

 

প্রশান্ত বারিকের কবিতা

হ্রেষা


(সমীরণ মজুমদার শ্রদ্ধাভাজনেষু)


শিরাওঠা দুরন্ত পা, একজন নিঃসংজ্ঞা জেদি মানুষ মগজে দপদপ লবণ ফস ফরাস,
বাংলার আকাশ-খাল বিল নদী -অরণ্য প্রান্তর -তামাটে শরীরের রক্তে মিশে
তরল খনিজ হয়ে মাটিতে ঝরে ঝরে পড়ে,বাতাসে ছড়ায়----
তাঁর  দৃঢ় মুখের রেখায়-ঠোঁটের কোনে,চিবুকের ভাঁজে হরপ্পা মহেঞ্জোদারো- টেরাকোটা,
লোকায়তি জীবন-বুকের ভেতর মহান বৃক্ষের অপার সান্তনা----
কলকাতা বইপাড়ার গলিখুঁজিতে ঘাম জ্যাব্জ্যাবে মাথা-কত নামী অনামী সৃষ্টিরর-
বোঝা কাঁধে,সূর্যকে ছুঁতে চাওয়া অপার্থিব ঘোড়া  যেন, রক্তফেনা মুখ-
দুরন্ত পায়ের তলে গলিত  গ্রীষ্ম  দুপুর -

রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট দিয়ে রিকশাভরা কাগজের লটি যায়
রঙিন ন ছাতা মাথায় নিতম্ব ছলকিয়ে হাঁটে হাইব্রিড কলকাতা সুন্দরী
লেখক, প্রেসমালিক, বাইন্ডার,বুকসেলারকে সাথে অনেক কেজো কথা
পুরোনো বাড়ির শ্যাওলামাখা কার্নিশে কাক ডাকে,
ধুঁয়াওঠা রান্নাঘরের চালে শালিকের কিচির মিচির-
ধ্বসেপড়া দেয়ালের হিলহলে চারাগাছগুলো পাতাচোখে রোদেপোড়া মানুষটিকে দেখে
ছুটতে- ছুটতে গঙ্গার জলে সূর্য  কখন  রক্ত উগলায় যায় না বোঝা,
বইয়ের সিন্দুকে ঠাসা আলো আঁধারির দীর্ঘ  বারান্দা পেরিয়ে -
একচিলতে আকাশের নীচে পাইসহোটেল।

কলকাতায় অনবরত ধোঁয়াওঠা মাড়ের গন্ধ,
ড্রামের তেলতেলে ঘোলাজলে অভ্যস্ত হাত খুঁজে নেয় মঙ-
শালপাতার থালাভরা ভাত নিয়ে বেগবান ফিনফিনে লোকটির-
মাথা থেকে টপটপ ঝরে ঘাম, সেই ভাতের উপর----
দুসারি প্লাস্টিকের টুলের সামনে কংক্রিটের দেড়ফুটি মলিন টেবিল
চারাপোনার ঝোল,আলুভাজা,ডাল,মৌরালা মাছের টোক,গরম ভাতের সাথে মিশে যায় সব
ক্ষুধাহাত তুলে নেয় গ্রাস, অগ্নিজিহ্বায় পরমান্নের সোয়াদ-শান্ত হয় হ্রেষামুহঁ,আগ্রাসি জধর---
কলেজস্ট্রিট বইপাড়া,কফিহাউস,আমার চোখে এক অনাবিষ্কৃত গোলক
হিউয়েন সাঙ,ভাস্কো ডা গামা,জর্জ কলোম্বাসের কথা সকলেই জানে
কিন্তু এই মেধাসমুদ্রের ভেতর তুঁপোকার আত্মক্ষয়ি ভাষাশিল্প,রংশিল্পর ব্যাপিত্তে নিমগ্ন
রক্তফেনা মুখে,শিরাওঠা দুরন্ত পা এই নিঃসঙ্গ মানুষটির জীবনকথা জানেনা কেউই
টুং টাং হাথেটানা রিকশা নিয়ে দৌড়ায় নাঙ্গা পা দেহাতি পুরুষ
ফুটপাথে রকমারি পাকাফল,জিলিবি,তেলেভাজা,হাতঘড়ি,প্যান্টি-ব্রেসিয়ার,কামসুত্র,
চশমা, রুমাল,হাইরাইজের গর্ভমুখ থেকে পিলপিল বেরিয়ে আসে ঘরমুখো মানুষ------
কফিহাউসের স্মৃতিবিধুর সিঁড়িবেয়ে-ভারী ব্যাগ চেয়ারে ঝুলিয়ে ক্লান্ত মানুষ্টির
সামান্য বিশ্রাম। আর তখনই ঘাপিমারা ব্যথাটা তাবত শিরাতন্তু টেনেধরে ক্রুর অস্তিত্ব  জানায়
সামনে দাঁড়ানো সাদা পোশাকের বেয়ারাকেও ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে
তরুণ কবি এসে দিয়ে যায়  ভালবাসার গন্ধমাখা পত্রিকা ও বই-----

ব্লাককফির পেয়ালা হাতে অন্তহীন কোলাহলের ভেতর,একা একা রক্তাক্ত সময়ের ঢেই ভাঙন
ক্রমশ ইতিহাস হয়েওঠা একজন নিঃসঙ্গ জেদি মানুষ-----

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments