সঞ্জীব নিয়োগী

 

সঞ্জীব নিয়োগীর গদ্য

পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ


ঠিকঠাক তাক করার চেষ্টা। রেঞ্জের মধ্যে এসেছে বলে মনে হলেই ট্রিগারে চাপ। ...কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় আবারও। সুতরাং কলম কামড়ে বসতে হয় পুনরায় । ফিজিক্যালি নাও হয়ত সেই কামড়, কলমে; বা, বসা। পায়খানা করতে করতেও। আরে, একেক বার তো সাবমিট উইথড্র সাবমিট উইথড্র সাবমিট উইথড্র সাবমিট উইথড্র করতে করতেও, কিছু একটা কামড়ে ধরে মাথা।

গল্পে দাঁড়াতে দেবনা, কবিতাকে, এই কথা ভেবে ভেবে কাটে। ছবি যখন নিরন্তর, ভাবনার, সেখানে বৃত্ত কেটে বেরোবে শব্দগুলো বার বার; পেছনে ও সামনে হবে সঞ্চার। এবং ক্রমাগত। কীভাবে ধরলে বেশিতম কাছ থেকে শোনা যাবে বাজনা। যা, ব্যঞ্জনা। কানের কাছে বন্দুকের নল নিয়ে গিয়ে ঠেকাতে চাই, উড়িয়ে দিতে চাই মগজের ঘিলু, ধ্বনির। মৃত্যু দিতে চাই সন্দেহাতীত। তাহলে  কান-ই বা কেন। সামনে বা পেছন থেকে যেকোনও অবয়বে তাক্‌ করা যায় তো!

হ্যাঁ বেশ। তাও যায়। আরও বহু লক্ষ্যবস্তু আছে, যা, দ্বিধারহিত মেরে ফেলতে পারে ব্যঞ্জনার অতৃপ্তি। হোক না, খুঁজি আসুন। ...আমি  ক্রমে ক্রমে শব্দের/কবির/পাঠকের মৃত্যু কামনা করি। আমার নিবিষ্ট খোঁজ চলতে থাকে... মেরে ফেলার অব্যর্থ দাওয়াই। কীভাবে বানানো যায়।

শব্দ সীমাহীন নয়। সীমা-মুক্ত করা যেতে পারে তার যোজন-ক্রম। আর এই ভাবে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে কান চোখ মগজ নিয়ে আসার কথা ভাবা হয়। একটা কবিতায় শব্দেরা কতদূর আহ্লাদিত মুক্তি আর কাঙ্খিত মার্যাদা পেল, জনৈক কবি হলেন কী পরিমাণ নিঃস্ব আর সেই কবিতা পড়ে একজন পাঠক কতখানি মারা গেল এটা জানার লোভ বাড়ে। তার মৃত্যুর কৃতিত্ব কবির। আচ্ছা, কবির দেগে-দেওয়া পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জের শব্দশরে তার মরে যাবার হিসেবটা শতকরায় করা যায় না! ... দেখেছি, যায়। পাঠকও জানেন, যায়। করা যায়। আমাদের ধীরে ধীরে এও জানা হয়ে গেছে যে কবির ‘মতলবের’ দায় যেমন পাঠকের কাঁধে বাধ্যতামূলক চাপিয়ে দেওয়া যায়না, তেমনই পাঠকের ‘গতিবিধি/ভ্রমণ-স্বাধীনতা’ নিয়ন্ত্রণের বাঞ্ছা কবির মানায় না।

লিখতে লিখত কবি ভাবে,  যা আসতে চেয়েছিল, তা কি আসতে পেরেছে। বা, বলা যায়, শেষ অব্দি  যা এলো, তার সাথে প্রিমিটিভ প্রেরণার মিল-গড়মিল কতটুকু! মনে হয়, যা এসেছে, তা-ই আসতে চেয়েছিল বুঝি! সেটুকুই কথা ছিল আসার।

একটা কবিতা যেভাবে দেখা দিল, যে শারীরিক প্রকাশ তার ঘটল, এবং সেই বহিঃপ্রকাশিত শব্দ, বাক্য যেভাবে নাড়া দিল একজন রসগ্রাহকের মন, তা কতগুলো কারণের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। আরেকটু বিস্তারেও যে ভাবা যায় না তা নয়।… যেমন, কোনও কবিতারই স্থায়ী কোনও ‘মানে’ নেই। পৃথিবীতে কোটি কোটি মগজ। প্রতিটা মগজ-ই একে অপরের থেকে কোনও না কোনও ভাবে আলাদা। আবার প্রতিটা মগজ সারাক্ষণ পরিবর্তনশীল! দেশকালযুগ সাপেক্ষে ‘মূল্যবোধ’ বদলে যায়। বদলে যায় একই কবিতার মানের অভিঘাত/মাত্রা, সময় সাপেক্ষে।

।।দুই।।

এক্ষণে থাকুক সে-সকল কচকচি। ... আমাকে নিজের কবিতা এখানে পড়তে হবে। নিজেকেই সেই কবিতার ভাষা বুঝতে হবে। ...কাজটা বরাবরই আমার অত্যন্ত প্রিয়। আকর্ষক। বেশ মজাদার। আকর্ষণটা, অনেকটা, নিজের শল্যচিকিৎসা স্বহস্তে। বা, হস্তমৈথুন। দেখা যাক না। আসুন।

“পরদেশি-৩
বস্তুগুলো খাওয়া। যার যা জানার
সাঁতারে তৃপ্ত
পূর্ণযতি নেই, সেই কথা কতবার চলে
মঝপথের ভয়

বড় করে ভেবেরাখা
বাইরে থেকে ঠেলে দিচ্ছে হাওয়া
এরকম গতি লেগে থাকে মনে মনে

এসব পুঁটলি নিয়ে খেই হারানোর
বেলা বয় গ্রহ ইত্যাদির
নিখুঁত প্রেমের দিন, প্রতিশ্রত পানি

ধুলো ঝেড়ে বস্তুত আবার বেজে ওঠা...”


এই সিরিজের চারটি কবিতা ‘সাপ্তাহিক কবিতা পাক্ষিক’ এর শারদীয় ২০১৬ সংখ্যায় বেরিয়েছিল। এক বছর বয়স হল কবিতাগুলোর। আমি এখন ওদের দেখি। এভাবে আমি আমার কবিতাদের মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে দেখি। দেখি আর অবাক হই। কে লিখেছে এসব! এমনও ভাবনা ঘুরে যায় মাথা। যে-আমি সেই কবিতাগুলো লিখেছিল, তাকে বোঝার চেষ্টা করি। সেই মানুষটার অবস্থান। সেই সময়ে। এবং কীভাবে সেই ‘সময়ে’ সে পৌঁছেছিল।

অনাঘ্রাত ‘বিষয়’ এর লোভ থাকে কম-বেশি সবারই। কিন্তু সে ‘উপায়’ মারাত্মক ভাবে ক্ষীণ। তাই, ‘নিজস্ব’ বলতে বাকি থাকে যে অবাধ অনন্ত জমি, তা আসলে ‘উপস্থাপনা/স্টাইল/কথন’ এর। কী বললে সেটা পরে দেখছি, দাঁড়াও। কীভাবে বললে সেটা চোখে ও মগজে আগে এসে যায়। কেন? কেননা আম-বেড়াল-কন্ডোম-গাছ-পাখি-মৃত্যু-বিবেক ইত্যাদি কত না বার এলো গো মহাজন এই শিল্প-শিল্প গগনে! আসল মনে থাকা তো, কীভাবে এলো, সেটা যাচাই করার ওপর নির্ভর। ... শব্দ, কোথায় বসলো; বাক্য, কীরূপে তয়ের হইলো! তুমি ‘আলাদা’ মান পাবে কেন, যদিনা ভিন্ন ‘ভাণ’ থাকে রচনায়!
  
।।কীভাবে এলো।।

নামকরণ প্রসঙ্গ। কেন পরদেশি।
আমি তো মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার পর থেকেই, কার্যত, ঘর-ছাড়া। আরও আগে গেলে যাওয়া যায় না তা নয়। তখন বলতে হয়, ঢাকা থেকে ঠাকুরদা দেশভাগের অনেক আগে সাঁওতালপরগণায় ভাগ্য-অন্বেষণে আসেন যখন, ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, ৪৭ এর পর ভিটে-মাটি ভিন্ন দেশের, কাঁটাতারের। যাইহোক, এসব বাদেও লেখা-পড়া আর পেটের দায়ে ১৯৮৩ সালের পর আর কখনও স্থায়ি ভাবে ফিরে যাওয়া হয়নি আমার সাঁওতাল পরগণার জন্ম-ভিটায়। ...এই সিরিজটা যখন লিখছিলাম, তখন, ততদিনে, মাঝে সাত বছর একসাথে থাকার পর আবার বউ-ছেলে-মেয়ের থেকে প্রায় ১৫০ কিমি শারীরিক দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছিল। ...তদুপরি, ইহ জগতে যে আমরা ‘পরদেশি’ এই বোধ মাইথোলজিকালি পেয়ে এসেছি আমরা। সবকিছু মিশে-টিসে নামকরণ।
   
।।কীভাবে আনলাম।। 

বস্তুগুলো খাওয়া। [এই পৃথিবীটাকে আমি যখন হাতে পেলাম, দেখছি, অনেকেই নানাভাবে বস্তুবিশ্ব আর ভাববিশ্বকে এঁটো করে রেখেছে, ক্রমাগত। অনেক ‘পড়ে-ফেলেছে’ তাকে। আমি কি ওগুলো থেকেই খাব? ...হ্যাঁ, তা ভিন্ন আর পথ নেই। এবার যা থাকছে, তা, দুনিয়াটার সাথে আসনাই করার পদ্ধতিটা কী হবে, আমার। যাকে ‘আমার’ বলা যাবে!]  যার যা জানার  [এটুকু বলে থেমে গেছি। পুরোটা বলিনি। উদাস হয়ে গেছি। পাঠককে বুদ্ধিমান ভেবেছি। অব্যক্তর স্বাদ ‘বানাতে’ চেয়েছি। যার যা জানার, সে তার নিজের জার্নি থেকেই তা জানে। সে-জানা ভাসা-ভাসা জানা নয়, তার চেয়ে ঢের বড়, গভীর, প্রশান্ত কোনোকিছু।] সাঁতারে তৃপ্ত [পথ চলা। জীবনের, জানার, আসলে কি, একজাতীয় ‘সন্তরণ’ নয়? এই ডুব-সাঁতার, চিত-সাঁতার ভাসমান রাখে চেতনাকে। সেই ‘সাঁতার’ চলতে থাকে চির-অতৃপ্তির কারণে, এবং এই চির-চলা, খোঁজ, তৃপ্ত রাখে কোনও না কোনও ভাবে, তাই থামতে দেয় না। পূর্ণযতি নেই, সেই কথা কতবার চলে । একই বৃত্ত, বহুবার আসে, প্রতিবারই নতুনতর, তাই বারবার আসে। নতুন হয়ে আসে বলে। সেই কথা কতবার চলে। অচল হয় না। বোধ ও ভাবনার বৃত্তে, পূর্ণযতি নেই, সেই কথা কতবার চলে । 
মঝপথের ভয় । বেশ, এখানে প্যারা বদল করলাম। ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি…’ ইত্যাদি জানি, স্মৃতিতে খোদাই। এই মাঝপথ কি সেই মাঝপথের দিকে ইঙ্গিত করে? হতে পারে। নাও হতে পারে। আবার হ্যাঁ, করে; আর তাছাড়াও আরও কিছু বলার চেষ্টা করেছে এই ‘মাঝপথের ভয়’। কীরকম? ‘পূর্ণযতি-হীন’ চলায়, সারাক্ষণ যেন এক ‘মাঝপথ-অনুভব’ কাজ করে। মানে খুঁজে না পাবার অ্যংজাইটি! বৃত্তহীন, তিরের মতো সোজা সাঁ সাঁ বেরিয়ে গেলেও ফিরে আসতে হয় বৃত্তেরই মায়ায়, যদি না মাধ্যাকর্ষণ ত্যাগের গতিবেগ সঞ্চিত হয়! “...বড় করে ভেবেরাখা / বাইরে থেকে ঠেলে দিচ্ছে হাওয়া / এরকম গতি লেগে থাকে মনে মনে...” এরকম বিষাদ তখন মানিয়ে যায় কবিতার গায়ে। চলে আসে, আনতে হয় না। 
এসব পুঁটলি নিয়ে খেই হারানোর...। সঞ্চয়, স্মৃতি। পুঁটলি আর কীসেরই বা! অতীত আর বর্তমানের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মাঝে মাঝে ‘খেই হারানোর’ অনুরণন বেজে যায় চেতনার অতীত! আমার সাথে সাথে এই সব খেলা খেলতে খেলতে তো বেলা বয় গ্রহ ইত্যাদির । আমি ধীরে ধীরে আশা বাড়িয়ে ফেলি। পেয়েও যাই হয়তবা, নিখুঁত প্রেমের দিন, প্রতিশ্রুত পানি । আচ্ছা, নিখুঁত শব্দটা এসেছে কেন? প্রেমে তো এমনিতেই ‘খুঁত’ নজরে পড়ে না! এখানে দুটো কথা তবে বলি। আক্ষরিক অর্থেই, মাত্র দুটো। এক, হ্যাঁ সেই ‘প্রেম’ –ই তাহলে চাওয়া হয়েছে এখানে, যেখানে আর যেন কোনও ‘খুঁত’ চোখে না পড়ে। সেরকম প্রেমদিনযাপন! আর দুই, বহু ঘাট ঘুরে এসে, ‘মন’ যখন বুঝতে পারে, সে আসলে যা খুঁজে এসেছে ঘাটে-আঘাটায় এতদিন, তা তো শরীরে থাকেনা! ...আর সেই জন্য ‘নিখুঁত’ হবার সম্ভাবনা মরে যায়নি আজও। চাওয়া যায় তাই, সেরকম কিছু একটা বিনম্র নিবেদনে! যা, তৃষিত ভুবনে “প্রতিশ্রুত পানি”। কেন, ‘প্রতিশ্রুত’ কেন? কে আবার প্রতিশ্রুতি দিল? লিখলেই [চাইলেই] হলো যা-তা! ...না পাঠক। ভেবে দেখুন, কালে কালে যুগে যুগে নারী-পুরুষ উভয়ে উভয়কে সুগভীর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে বইকি! সেই প্রতিশ্রুতি বহন করে চলেছে তারা আজও। ...আবার নারী-পুরুষের সীমা থেকে ‘প্রতিশ্রুতি’ শব্দটাকে বের করে এনে, এখানে, বৃহত্তর পরিসরেও ছেড়ে দেওয়া যায়। এভাবেই, চাওয়া-পাওয়া আনন্দ-হতাশার “ধুলো ঝেড়ে বস্তুত আবার বেজে ওঠা...” ।



বি.দ্র.:  পাঠক ‘ব্যক্তি-আমার’ মুখ দেখতে না পেলে বেশি ভালো হয় কি?  আমি যেমন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ বা বিনয় মজুমদারের মুখ দেখতে পাইনি। তাঁদের কবিতাই মুখ হয়ে জেগে আছে আমার সামনে, সেই সব কবিদের।  পাঠক আর কবির মাঝে কবিতাই সেতু। এমন কী মধ্যস্থতাকারী কোনও পুরুত/ যাজক / মৌলবির প্রয়োজন নেই। কবিতার ঈশ্বরের কাছে উপাসক নিজে নিজে পৌঁছে যাবে। সেটা তার নিজস্ব জার্নি। পরের ইয়ে ধার করে  কি আর হিসি করা যায়। তাকে নিজে ‘মরতে হবে’ পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে চলেগিয়ে!    

6 comments:

  1. নিজস্ব ভাবনা থেকেই নতুন কিছু পাওয়ার থাকে।আলাদা কে পাওয়ার থাকে।তাই পেলামও,ধন্যবাদ আপনাকে। @ অভিষেক ঘোষ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুব ভালো লাগলো । নিজের লেখাকে এভাবে আঁশ ছাড়ানো•••@সৌগত বালী

      Delete
  2. ধন্যবাদ। নমস্কার জানবেন।

    ReplyDelete
  3. আনন্দ পেলাম। কবিতাতেও। অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  4. কবির ব‍্যাখ‍্যা তো সবচেয়ে উপাদেয়। এত গভীরে আমি যেতে পারতাম না। ঋদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  5. বড় আনন্দ পেলাম। কবিতা একটি খোঁজ, এক অফুরন্ত জার্ণি। অচেনাকে চিনে চিনে জীবন ও কবিতা...

    ReplyDelete

Facebook Comments