পীযূষকান্তি বিশ্বাস




পীযূষকান্তি বিশ্বাসের পাঠকামি


পাঠকামি -১৯

ডাকে আসা বইগুলোর প্রতি আমার একটু তাড়াহুড়ো থাকে । আর এই দূর দিল্লিতে থাকার কারণে বাংলা বই তেমন পাওয়া যায় না । যা কিছু পাওয়া যায় সব ওই 'বিখ্যাত' কবি বা 'পুরস্কার' প্রাপ্ত বই না বলে যা দউ একখানা বাংলা বইয়ের দোকান আছে তারা রাখে না । আর বাংলা বই সংগ্রহ মানে লিটল ম্যাগ বা বইমেলায় যাওয়া হলে । তাও ব্যাগ ব্যাগেজের কারনে , বোঝা বেশী ভারী করা যায় না । এই মত অবস্থায় কুরিয়ার বালা এলেই আজকাল মনে হয় কেউ বই পাঠিয়েছে । আজকের বই- একটা কবিতার বই, যে কবির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় বা দেখা সাক্ষাৎ নেই ।


গড়দূরত্বের স্বরলিপিঃ সঞ্জীব নিয়োগী



কবিতার বই আমি আগোগোড়া স্ক্যান করি না । হয় শেষ কবিতা আগে পড়ি কিংবা প্রথমটা প্রথম । কবিতাগুলির নামকরন নেই । টাইটেল লেস ।

"কুয়াশার মাঝরাত ভেতরে ভেতরে পাকা ধান । অঘ্রানের পরবের দিকে নিয়ে গ্যালো , খুব ভাত খাওয়া হবে রাতদিন জেগে জেগে..." - (পাতা-৭) ।

কবিতার বিষয় বস্তু যেখানে ক্ষীণ হয়ে আসে , স্ট্রাকচার জায়গা করে নেয়, ঐটাই প্রধান হয়ে আসে । ধান পাকুক বা না পাকুক অঘ্রান চলে আসে । সেই কবিতায় কোন নামকরণ মাহিনা রাখে না ।

গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জেনেছি চুনোপুঁটির কি মানে হয়, আর বোয়ালের জ্যাবড়া কি জিনিস, এর সঙ্গে ছোট নোট আর বড় নোটের মেটাফর ও যায় , আসলে কথা কি কোন সময়ে দাঁড়িয়ে কোন কথাটা বলা জরুরী, কিভাবে সাধারণ জীবন থেকে গল্প উঠে আসে, সেই ক্রেডিট লেখকেরই প্রাপ্য ।

"অথচ ভালো ভালো শব্দ তো বেশী থাকেনা, গালে হাত বুলোও বা গোলাপ চারায়..." (পাতা-৮) ।


ভালো কবিতার লাইম লাইট নিয়ে যায় আলোকিত সজ্জা, শব্দ ও ছন্দ । কবির সাধ আহ্লাদ সেখানে গৌন । কেউ যেন বলেছিলো , আমায় নহে গো, ভালোবাসো , শুধু, ভালোবাসো মোর গান । এখন কবিতায় আপনি কি নেবেন ? শব্দ নাকি ছন্দ নাকি গল্প । ভাববাদী ও অলংকারবাদীরে যত অঘোষিত যুদ্ধই করুক এই কবিতা নিয়ে আসে আসল উপলব্ধি । গোলাপের চারায় হাত রাখার উপলব্ধির কথা বোধ হয় পাঠক কোনদিন জানতে পারেন না ।

"জেগে জেগেই স্বপ্নগুলোকে মাত্রা আর লাগাম দিতে দিতে অনেকবারই বক্তব্যের দিকে স্পষ্ট ভাবে হেঁটেছে" - (পাতা-১৪) ।


কবিতাগুলো যখন পড়ি । অনেক সময় বাই ইনটিউশন একটা মানে করার প্রবনতা থাকে । এটা আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় । যখন লিখি , শুরুর দিকে তাই থাকে, পরে তার গন্তব্য পালটে যায়, এবং এই যাত্রা নিয়ে পরে যদিও কোন আপসোস থাকে না । কবিতার মাত্রা আর মানে তাই একটা নির্দিষ্ট দিকে যেতে চায়, অন্তত একটা মানে তো দাঁড়াবার কথা । এইখানে হলো মজার কথা । ল্যাঙ্গুয়েজ । কি ভাষায় কবিতাটা লেখা হয়েছে । যেহেতু বাংলাও একটি ভাষা, তাই ঐটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যায় । কবিতার ও যে নিজস্ব একটা ভাষা আছে , ঐ টা গুলিয়ে যায় । এই খানে লক্ষ্য করার মতো হলো কার দরকার বেশী । কবির কবিতা বোঝানোর নাকি পাঠকের কবিতা বোঝার ? বক্তব্য তো একটা রাখতেই হয় ।

তাহলে বাংলা কবিতার আর কি দাঁড়িয়ে থাকলো ? ভাষাটাই যদি না থাকবে, কিছু তার অর্থ ? কি হবে তার বিষয়-আশয় ? এই সব গল্প, কাহিনী আর ছন্দের কোন দাম নাই ?

"অনেক দাম চুকিয়ে আগলে রেখেছ সামান্য ধ্বংসপ্রায়...সহজেই ভুল বুঝোনা, উহ্য থাক ক্রিয়াপদের সরলীকরণঃ এই সাধারন , সমানুপাতিক গা-গতর , কথা শোনো , এমন কোন পতন তোমার ঘটেনি " (পাতা-১৬)।


এর কি অর্থ হবে ? এই যেন নিজেরই বোধ, নিজেরই কবিতা উঠে আসে । আগেই বলেছি, বক্তব্যতো একটা থাকবেই, আর যেহেতু তাতে কোন ধামাকা নেই, এই সাধারণ কথা দিয়ে আর কতকাল অসাধারণ হবার প্রতিছবি হয়ে থাকবো ? এই কবিতার কি অর্থ । আমি অর্থ মানে টাকা পইসা , খ্যাতি, যশ, ব্যাংক ব্যালান্স বুঝি ।

কবিতা পড়তে গিয়ে দেখেছি বিস্তর মাঠ পড়ে আসে, নানান ধরনের ফসল ফলানোর জমি । নানার ধরনের রসের আনাগোনা । আসলে দিনের শেষে কবিতা একটা শিল্পই । শিল্পী হিসাবে আপনি কতটা ফাইন করে তুলতে পারেন এইটা আপনার পরীক্ষা । তাতে আপনি যাই করেন ওটা কবিতাই । হারমোনিয়াম পেড়ে ফেলে দুলাই গলা খাকারি দিলেও ওটা গানই । এর জন্য আপনার দশতাল না জানলেও চলে আর সাইত্রিশতম রাগীনির খোঁজ না পেলেও । মৌলিক বা যৌগিক এই নিয়ে যোগীরা তোলপাড় করে ফেলছে সোসাল মিডিয়া আর কবি সঞ্জীব নিয়োগী তখন লিখছেন ।

"তেত্রিশ কোটি চুমু পার হয়ে সন্ধ্যা মানে উচ্ছাসের, উচ্ছিষ্টের, সন্নাসের গান । এই যে চাবির মতো কিছু একটা শুয়ে থাকছে অন্তরালময়। তাকে একটু সহজ শরীর খুঁজে দাও" (পাতা-২৭)।

এই খানে 'উচ্ছিষ্ট' কথাটা এমন ভাবে উঠে আসছে, মনে হচ্ছে অপবিত্র হয়ে যাচ্ছে সমস্ত ঈশ্বরীয় চিন্তা ভাবনা আর চর্চিতচর্বনের শিল্প কলা । আর সন্তানের জন্ম দিতে দিতে একদিন সমস্ত শিল্পীরা ক্লান্ত হয়ে আসে, সমস্ত পুরুষমহিলা কবিরা লিংগভেদে মা হয়ে ওঠেন । তখন আর একটা জন্মের জন্য তাদের একটা শরীর দরকার হয় ।

কবিতাতো পাঠ করতেই হয় । পাঠের ভিতর কবিতা লুকিয়ে থাকে । তাকে খুঁজতে হয় । মাস্টারি চলে না । বোধের ভিন্নতায় নানান ব্যাখ্যা হয় । কিছুটা কবির সঙ্গেও মিলে যায়, কখনো মেলে না । রসের তারতম্য, বোধের ভিন্নতা সরিয়ে একটা ব্যাপার ফাইন হয়ে ওঠে । তরঙ্গ ছুটতে থাকে । পোয়েম ইস আল এবাউট এ মেটাফর ।

"কিছুক্ষন এই ভাবে থেকে বডি মিহি আইরনির তোয়াক্কার পাশেঃ বারবার পিছলে যায় গুনোত্তর প্রগতির করতলের মতো, উপমা খুঁজতে সকালগুলো গুটি গুটি ক্রমশ পুতুল..." (পাতা-৪২)।

এই ভাবে চলতে থাকে কবি, সরলরেখা বরাবর মেদহীন হেঁটে চলা । উপমার ব্যবহার স্থবীর করে দিয়ে কবির ভাষা ক্রিয়াপদ হীন হয়ে আসে । ক্রমশ । কবিতার চলনে কোন ক্যাট ওয়াক নেই বরং সোচ কা বিচার বা পরিধান বিশেষ উল্লেখ্য । কতটুকু পরলে কোমর দেখা যায় আর কতটুকু পরলে নিতম্ব বেরিয়ে আসে । জিরো ফিগার বেরিয়ে পড়ে কবিতার আলোকময় চিত্রনাট্যে । কবিতা পাঠ করে আমার কেমন লাগলো ? এক কথায় তান্দুরীর মতো । কামড় বসালে ক্রিস্পি ও কাঠের পোড়া গন্ধ আসে , কিন্তু মাংসের ভিতরে প্রোটিনের আধিক্য নজরে আসে সেখানে ব্রাস মেরে বাটার লাগাতে হয় । আর স্বাদ তো নিজের মত করেই নিতে হয় । জিভেই কোন রক্ত না লেগে থাকাই সভ্যতার ঝলক । কবিতা সেখানে মাত্র একটা উপস্থিতি, কবি জানান তার নিজস্ব একটা অবস্থান বাংলা কবিতায় আছে ।

"বুঝতে পারছ উপস্থাপনার ছায়া, ডাক দিচ্ছে সক্রিয়তার ঢেউ । চাঁদ চাঁদ টী নিষ্ক্রিয় কপাল কপালে নিশাচর গোপনের হাসি আর প্রক্ষিপ্ত উপকাহিনীর নির্ভর পান্ডুলিপি" (পাতা ৪৫) ।

আমার পাঠ আজ এই পর্যন্তই থাকলো । নিজস্ব বোধ ও ভাবনা নিয়ে এই পাঠ আগামীতেও চলতে থাকবে । এই পাঠ ও তার থেকে উঠে আসে ভাবনা , এ আমার একার ও আপেক্ষিক । এর কোন বানিজ্যিক মূল্য নেই, বা প্রকাশযোগ্যতাও । মূলত, এই বিদেশে বসে যেটুকু বই পাই তাদের দাম চুকানোর সাধ্য আমার নেই বা সুযোগও থাকে না । সেইটুকু ধন্যবাদ জ্ঞাপন অন্তত আমার এই পাঠকামিতে থাক । এই কবিতা নিয়ে খেলতে থাকা ব্যস্ত কবিদের কপালে চাঁদমামা টী দিয়ে যাক ।












পাঠকামি-২০


পাঠ করার আগেই,আর একটু আড়ষ্ঠ হয়ে আছি । একটু কঠিন হয়ে আর যেখানে হওয়া উচিত তরলবৎ, কারন, বইটির বানান ভুলের জন্য একবার ক্ষমাপ্রার্থী । মোবাইলের অভিধানের কারনে যেকোন তরল, তরুন হয়ে যেতে পারে । হেঁয়ালি নয়, যাদবদার এই বইটি আমি ডাকযোগে পাই । যাদবদা, যাদব দত্ত, তরল পাখি ও শ্রীমতী মেরিনড্রাইভ বইদুটি আমাকে পড়তে দিয়েছেন ।


তরল পাখিঃ যাদব দত্ত ।



হাতে নিয়ে বোঝা যায় বেশ কিছু বছর কেটে গেছে মাঝে । গঙ্গাবক্ষ দিয়ে তরল নেমে গেছে ক্রমাগত । কাগজে নমনীয়তা এসেছে, ধুসর হয়ে এসেছে অক্ষর । একটা গন্ধ টের পাচ্ছি, গন্ধ এসে লাগছে , জুঁই না ভাত ফুটছে অলিক জানে না ।


"গন্ধে বুঝতে পারি মন কোথাও সিদ্ধ হচ্ছে
মগ্ন সাদা বেলি ফুলের চিত্র কলহে
যেন কোথাও নেমে আসছে নক্ষত্রের আলাপ
তাপে অনুতাপে
..
...
তবু ভাতের গন্ধে এসে কেউ যেন প্রতিদিন
ঠোট থেকে রোদ খুলে নিয়ে যায়" --- কবিতা "ভাত" ।

কবিতার শুরু দিয়ে একটা জিনিস বুঝি দিনের শুরু ও শেষ ভাত দিয়ে, আর ঠোট থেকে কি করে যে রোদ খুলে যায় । এক মগ্ন চেতনার উদ্ভাস ভাতকে রসসিঞ্চিত করে তোলে । কবিতায় শুরু হইয়ে যায় কবির শুভযাত্রা ।

"একদা গাড়ির চাকাতে তুমিই লাগিয়েছো ঝুরো রোদ্দুর
পশমী ছোঁওয়ার তাই হাওয়াকল আজও চলছে শীত থেকে
বসন্তে কাঁচি ছুরিতে" --কবিতা হাওয়াকল ।

আমার হাওয়াকলের অভিজ্ঞতা আছে । সত্যিকারের হাওয়াকল দেখা আছে । তাদের সাই সাই পিস্টনের আওয়াজে বালিহাঁসের উড়ে যাবার আওয়াজ । একধরনের পরাবস্তব অভিজ্ঞতার সামনে এসে দাঁড়াই । কবিতাকে নিজভূমিতে প্রতিষ্ঠা করেন কবি যাদব দত্ত ।


"মেটেরনিটি ওয়ার্ডে কেন ভেঙ্গে যায়নি এই ঢালু জল
অথবা অন্তরীক্ষ-উদর থেকে কেন নামায়নি কেউ শ্রেষ্ট বীজ
আষাড়ের প্রিইয়দিন । তাহলে নাভিতে নাভিতে নিহিত গাছ কি করেছিলো--
স্মৃতির উপসনা । যেখানে চোখ বুঝলে তরল শীতল ছায়া
গাছেরই অন্ধকার সুখজন্ম । " ---কবিতা সুখজন্ম ।


যতদূর এই কবিতাগুলো পড়ছি, আলাদা একটা দেখার কথাই মনে পড়ছে । এক অবচেতন মনের দেখা, নিজের ভাবনাগুলোকে সচেতন ভাবে বিন্নস্ত করা । কবিতায় আধুনিকতা আছে, জীবনানন্দীয় প্রভাব সম্পূর্ন মুক্ত নয়, কিন্তু নিজস্ব টাচে আলাদা সুক্ষতা ধরে রাখছে কবি যাদব দত্ত ।


ভালো লাগছে নার্সিংহোমের দিন, প্রাপ্তবয়স্ক বেলুন । কত সহজে বলে দেওয়া যায়
"পৃথিবীর সমস্ত উত্থান-পতনের ইতিহাস
যে ওই পথ দিয়ে বয়ে নিয়ে গেছে ডানার ওমে" ---কবিতা তরল পাখি ।


ঘোড়া চরাবার মাঠ, রাণি এলিজাবেথের মোজা, টানা নীল নাইলনে বেশ লেগেছে । ভাবনার প্রসারতা আছে । রেক্সিনে বাঁধা পৃথিবিতে রস আরো একটু রস সিঞ্চন করা যেতো ।

এই বইটির সেরা কবিতা হলো মের্টিনিটি ওয়ার্ড । ব্যালান্সড । ভাষা, নতুনত্ব, বিষয়হীনতার বিষয়, নন্দনত্বহীন এক আবহমানকালের কবিতা । কাকাতুয়া নিয়ে ঘরে ফিরছে পেপে গাছ । পারফেক্ট মেটাফর ।


আরো কিছু কবিতা আমি পড়লাম । অসম্ভব, পালক যে উড়ে আসবে, ছুটির দুপুর অন্ধকুয়ো থেকে । বেশ ভালো লেগেছে । আজ এই বইটির পাঠ এই পর্যন্ত, কাল শুরু করবো শ্রীমতী মেরিন ড্রাইভ ।




পাঠকামি-২১



কবি যাদব দত্তের সঙ্গে কোনদিন দেখা হয়নি । মানে, আলাপ পরিচয় বলতে ফোন কল আর ফেসবুক । তথাপি, আমি দিল্লি আর কবি জামসেদপুর । উপায় যখন ইচ্ছের অধীন, দুটি বই দিল্লি পাঠানো এই যুগে অসম্ভব কিছু না । দূর দূরান্তের চিত্রকল্প নিয়ে ড্রাইভ করা কবিদের প্রতিদিনের অভ্যাস, আর আজকের এই পাঠ সেই নিয়ে শ্রীমতী মেরিন ড্রাইভ ।


শ্রীমতী মেরিন ড্রাইভঃ যাদব দত্ত ।


কবিতায় যাবো । লং ড্রাইভ । আগের বইটি পাঠ করে মোটামুটি লাঞ্চপ্যাড রেডি । কবির কল্পনায় ভর করা যাক।

"যে পোষাকের নাম হয়েছে সুঠাম বাতাসের দল
বিছানায় ডুবো চাঁদ তারই বাষ্পক্রম ভেঙ্গে
ছেঁকে ছেনে তুলেছে নেশাটিয়া
অবদমিত স্কাইস্ক্রুপারের মাপে" ---কবিতা "পুনর্বার" ।

এইটুকু বুঝতে পারলাম রাস্তা বাম্পি, আর কঠিন হাতে স্টিয়ারিং ধরে আছেন কবি । তরল পাখি পড়ে যে আশা জাগিয়েছিলেন কবি যাদব দত্ত সেইটা থেকে ভিন্নতর এই যাত্রা । অনেক পরিনত এবং স্মুথ । নেশাটিয়া শব্দে একটা নেশা আছে, আর বিছানায় চাঁদ ডুবে গেলে এক অদ্ভুৎ আঁধার নেমে আসে । জন্মের স্বাদ পেতে চায় রক্তমাংস । প্রতিটা লাইন দিয়েই এক একটা ভাবনার মালা গাথা যায় ।


কবি কিছুটা টেকসেভি , কিছুটা গ্রাম্য, কিছুটা রোমান্টিক মুডে কবিতা লিখছেন। এর ভিতর থেকে একটা আবসার্ডিটির জন্ম নিচ্ছে, চিত্রকল্প ডিসটর্ট হচ্ছে, স্নায়ুযন্ত্রে আঘাত করে ফিরে আসছে শব্দবন্ধ ।


"জেগে উঠেছে তুষার ব্রিজ
নিস্তব্ধ দুপুর খেয়ে তারও বিপ ধ্বনি
কোথাও যেন ব্রার পাতলা ফিতে পার হচ্ছে মসৃন ঘন্টা
রাতের বুটি বুটি দাগগুলি নুন মাখিয়ে দিচ্ছে
তার আয়নায়" --কবিতা "অনর্গল" ।

অমায়িক কবিতা । অভিনব । এর ভাষা, বিষয়, কনটেক্সট সুইচিং আলাদা । নিজেকে ভীড় থেকে আলাদা করে নেওয়ার মত এটিচুড । এমন একটা প্রিপারেশন, সচেতন মেটাফরের প্রয়োগ অথচ হেজিয়ে ওঠেনি কোথাও । কবি জানেন কতটা নুন এখানে মিশিয়ে দিতে, কতটা রস সঞ্চার করতে হবে । নিজেরই প্রতিবিম্বের সামনে এসে দাঁড়াতে হবে একদিন ।


"সিগারেট জ্বালানো যায়
ঊষাবে পূব ভূর ভূর বেরোবে আলোর মহিষ
মোম আর মোমবাতির আলোয় বস্যচিত্র
ছুঁচে সুতো পরিয়ে যে কেউ ঢেউগুলোকে শান্ত করে " ---কবিতা "শ্রীমতী মেরিন ড্রাইভ -৩" ।


এই কবিতায় আর একটা ডাইমেনশন আসছে । শ্রবনপ্রিয় ধ্বনির ব্যাবহার আর সঙ্গে যাপনের তন্ময়তা । ভূর ভূর বেরোবে কথাটায় এমন একটা মহল সৃষ্টি করে যার যার ভিতর একটা শ্রদ্ধেয় কবি বারীন ঘোষালের ম্যাজিক লক্ষ্য করা যায় ।


"গন্ধের পট আঁকি সেই নৌকা জবাকুসুমে ভরাই
নামের আর গালের আঁচিল পাল্লা খোলো
একটু ওড়াওড়ি ধরে রাখা নগ্ন ধনুকের ফিসফাস শব্দে " ---কবিতা "আলোর খাঁজ ।


টিপিক্যাল বিষয়হীন নতুন কবিতা । নতুন কবিতার সঙ্গে যতটা পরিচিত, যদিও আমার দৌড় ওই বইমেলা পর্যন্তই, এর পক্ষে বা বিপক্ষে বলার মতো আমার কাছে কিছু নাই । এইটুকু বলার নিজস্ব পাঠের একান্ত অনুভূতিতে এই কবিতার স্ট্যান্সই আলাদা । খাড়া, ঋজু । 'নামের আর গালের আঁচিল পাল্লা খোলো '-এক অসাধারন উচ্চারণ, আর 'নগ্ন ধনুক' এমন একটি লাইন পর পর আসছে, কবিতাকে কম্প্যাক্ট করে তুলেছে । এবসার্ডিটি আছে , আবস্ট্রাকশন ও আছে । শ্রুতিমধুর আর চিন্তাকল্পের নির্যাস ।


আসলে আরো অনেক কবিতা নিয়ে আলোচনা করা যায় । রাস্কেল, লাখোটিয়া, নবনীতার পা, ওস্তাদ, ইডিয়ট, বৃষ্টির পর চাঁদের বাহিনী ।


"আখমাড়াই কলে
পেতলের ঘন্টায় ঘুম পাড়িয়ে রাখবে;
সিড়ি নামানো
হাতের মেঘ ধরে যেখানে ছেলের বাবা
সাঁকো পেরুচ্ছে পিঠের তিলদাগ পেরুচ্ছে " ---কবিতা "তিল" ।


এই কবিতার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি অন্য যাদব দত্ত । নৈস্বর্গিক চিত্রের এক আজব কল্পনা । এটাকি স্যুররিয়ালিস্ট বলে ? অবচেতন মনের অনুল্লেখিত রচনা । নৌকা পার হয়ে গেলে যে সাঁকো দাঁড়িয়ে থাকে, বছরের পর বছর, প্রজন্ম পার হয়ে যায় । সাঁকো দাঁড়িয়ে থাকে । পিতা ও পুত্রের যোগসন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে থাকে সাঁকো । অদ্ভুত কাব্য ভাবনা ।


পড়ে চলি, চলো গুনগুন, যুদ্ধ পাপড়ি । যথেষ্ট ভালো লেখা । এই লেখাগুলিতে কবি যাদব দত্ত নিজেকেই অতিক্রম করেছেন । এরপর শুরু হয় কাঠঠোকরার ভাষা সিরিজ । এই সিরিজটা লম্বা সিরিজ । ন্যারেটিভ আছে । পাঠক ফ্রেন্ডলি । বেশ বৈচিত্রময় । দাঁত ভাঙ্গে না ।


"উঁহু নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঠের পা
বন পেরুচ্ছে মন পেরুচ্ছে টমাটো খেত পেরুচ্ছে
এভাবেই জল ঢেলে জলছবি হয়ে " ---কবিতা "উঁহু গীত" ।

যাদব দত্ত ভালো কবিতা লিখেছেন । জলছবি নিয়ে, গ্রাম বাংলা নিয়ে, কৈ মাছ ধরা নিয়ে এমন কবিতা লিখে রাখেন, এক সাহিত্য মনন মিশে থাকে । টমাটো খেতে থেকে চিত্রকল্প তৈরী করেন । দ্যোতনা তৈরী করেন । সেই রকম কাজ করেছেন কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা সিরিজেও । স্বল্প দৈর্ঘ্যের কোয়ার্টাজ । এখানে গ্রামের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক জীবনও তুলে এনেছেন । এনালগের জীবন কে ডিজিটাল করে তুলতে চেয়েছেন । কবি যাদব দত্ত হয়তো পালটে যাবার নতুন সংকেত দিচ্ছেন ।

2 comments:

  1. পীযূষ দুই চেনা কবিকে আবার চিনলাম তোর আন্তরিক জায়মান বিশ্লেষনী ক্ষমতার দ্বারা.

    ReplyDelete
  2. গ্রেট !!!! কবির কলম ন্তুন খুলে খুলে বাংলা ভাষার ললাটে এঁকে দিয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ চাঁদনীর সৌহার্দ্য --- মুগ্ধ পাঠ !! দুজনকেই অনেক শুভেচ্ছা !!!!

    ReplyDelete

Facebook Comments