উমাপদ কর


 

উমাপদ করের গদ্য

কবিতার অতলান্ত- (দুই)

                               
জীবনের বিচিত্রতার জন্য জীবন মহার্ঘ। কবিতার বিচিত্রতার জন্য কবিতাও অনন্য। যে কোনো শিল্পকর্মের সঙ্গে তুলনা করাটা এক ধরণের অশোভন চ্যালেঞ্জ। কিছুটা অনৈতিকও। আমি তো মনে করি এক শিল্প-কর্মের সঙ্গে অন্য শিল্প-কর্মের কোনো আড়াআড়ি লড়াই নেই। বরং একে অন্যের পরিপূরক। আর এই পরিপূরকতা থেকেই মাধ্যম ভিন্ন হলেও শিল্প-কর্মের অন্বেষা আর ভ্রমণটি একটা সূতোর মধ্যে গাঁথা থাকে। যে কোনো মাধ্যমের শিল্পীর, তাঁর কাজের প্রতি স্বনিষ্ঠতা, আকর্ষণ, রিলেট করতে চাওয়ার আকুলি, আর কর্মে মজে থেকে আনন্দানুভব প্রায় একইরকম। শিল্প ও শিল্পীর যাচ্‌না, অভিরুচি, বাসনা, নান্দনিকতার ঔজ্জ্বল্য আবিষ্কার ও উদ্ভাসিত করার প্রয়াস, এবং মাত্রা ও অভিমুখ প্রায় একই তরঙ্গানুভূতিতে ও সমমেলে বাজতে থাকে। ফলে মননে ঘাত-প্রতিঘাত, রেজোনেন্স, আলো-আঁধারি যাই ঘটুক তার ফলশ্রুতি একই। ‘আনন্দ হি কেবলম’।
কবিতার অতলান্ত পর্যায়ে আমার প্রথম করা বারোটি নির্মাণ এবং একটি গদ্যের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে আমি আমার অগ্রজ, বন্ধু, ও অনুজদের কাছ থেকে বেশকিছু প্রতিক্রিয়া, গঠন-মূলক আলোচনা, কিছু
সাজেশন এবং বেশ কিছু প্রশ্ন পেয়েছি। এগুলি আমাকে ঋদ্ধ করেছে, প্রেরিত করেছে যেমন, আবার তেমন কিছু দায়ও চাপিয়েছে, যা আমি অস্বীকার করতে পারি না। প্রশ্নগুলো হঠকারি যেমন নয়, তেমন নয় ধ্বংসাত্মক বা  ফেলে দেবার। বরং তা যথেষ্ঠ স্বাভাবিক এবং গঠনমূলক। বিশেষ করে আমি যদি এ-কাজে নিয়োজিত থাকতে চাই, তাহলে এই-সব প্রশ্নের উত্তর আমাকে খুঁজতেই হতো। কিছু বিষয়ের উত্তর যে আমি দিয়ে দিতে পারব, তাও নয়। কাজে-কর্মে, চলায়, নব-নব নির্মাণ ও পক্রিয়ায় সেসব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই মিলতে থাকবে। এখানে বরং একজন উত্তরদাতা হিসেবে নয়, একজন আলোচক হিসেবে আমি উঠে পড়া প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হই, এবং নিজের ভাবনাকে শেয়ার করার চেষ্টা করি। শেয়ার করি কিছু প্রতিক্রিয়ার নির্যাস, যা আমাকে প্রেরণা দিতেই থাকবে।

এক অনুজের আগ্রহ, যে কাজগুলো করেছি, তা আমি ‘কবিতা’ নামেই উল্লেখ করব কিনা? ‘কবিতার অতলান্ত’ পর্যায়ে করা আমার এই সমস্ত নির্মাণকে আমি একটি ‘সন্দর্ভ’ (Text) হিসেবেই বিবেচনা করি। এবং চাই তা খোলা রাখতে। এই জন্য এগুলিকে আমি কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছি। একই সঙ্গে এও বলব, আমার উদ্দেশ্য ও অভীপ্সা একটি নির্মাণ, একটি Text, তা ‘কবিতা’ হলে আমার তো ভালোই লাগবে। সন্দর্ভ(Text) ধরলেও তা যদি পরিনতি বা প্রতিপাদ্যতাহীন বা Open ended হয়, তবে তাকে কবিতা বলতেও আমার বা কারোর দ্বিধা থাকার কথা নয়। দীর্ঘ দিন কবিতা নিয়ে জড়িয়ে আছি। তার প্রেরণা আর প্রভাব অস্বীকার করতে পারিনা। একই সঙ্গে সে যদি কবিতা না-ও হয়, বা ‘কবিতার মতো’ মনে হয় তাতেও কোনো আক্ষেপ থাকবে না। কারণ, সন্দর্ভকে যে কোনো নামেই ডাকা যেতে পারে। তবে এই পর্যায়ে আমি মনে করছি কবিতা নির্মাণ-কার্যে শুধু ভাষা-লিপির ব্যবহারই যথেষ্ট নয়। বরং ভাষা-লিপির বহর কমিয়ে আরও যেসব ভাঁড়ার উজার-করা লিপি রয়েছে, যাদের আমি লিপিই বলতে চাই, তা ব্যবহার করা। যেমন চিহ্ন-সংকেত-লিপি (Sign and Symbol), অংকন-ফটো-স্কেচ-লিপি (Painting, Photography, Sketch), গ্রাফ-বিজ্ঞান-অংক-সূত্র-সমীকরণ-সমাধান-লিপি (Graph, Scince-Math-signs-laws-theories-equation-deduction)। এ-সবই সন্দর্ভ নির্মাণের জন্য এখন লিপি, আমার কাছে। সৃষ্টির যে উদ্বায়ু অধরা অবয়বহীন ভাবনাটি আমার মধ্যে স্পার্কিং-ব্লিঙ্কিং-শাইনিং, তার নির্মাণের জন্য এইসব লিপি, যা সন্দর্ভটি বা কবিতা লিপিত করতে সহায়তা করবে, প্রাণপাত করবে। সঙ্গে চিরাচরিত ভাষা-লিপি ও ফাঁকা জায়গাতো রইলই। আমি নিশ্চিত সন্দর্ভটিতে, যদি নানাবিধ কৌশল সুচারুভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে শেষ পর্যন্ত তা কবিতাই হয়ে উঠবে। যদিও একে যে-কেউ যে কোনো নামে ডাকতে বা বলতে পারে। আসলে এটি সম্পূর্ণতই একটি মিশ্র-মাধ্যমের কাজ, যেখানে সম্মীলনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আবার এটি একটা খেলাও। বিভিন্ন মাধ্যমের সমন্বয়ের খেলা। নামকরণের ধার না ধেরেই। কবিতার অতল। অতল তক । এই সমস্ত কিছুর সম্মীলনে কবিতাই হতে হবে এমন কোনো পূর্বশর্ত না চাপিয়ে, অর্থাৎ কোনো প্রিকনসিভ মনোভাব না নিয়ে, যা হয়ে উঠবে তাকেই স্বাগত জানানো। পূর্বশর্ত চাপিয়েই কি সবসময় ভাষা-কবিতা কবিতা হয়?  সৃষ্টিতেই আনন্দ। কবিতা, গল্প, নাটক, দেখা-কবিতা, অংক-কবিতা, গ্রাফ-কবিতা, ইত্যাদি তথাকথিত নামে ডাকতেই হবে তার কোনো মানে নেই। তবে নির্মাণকারী একজন কবি, তাই তাতে কবিতার স্ফুলিঙ্গ থাকবেই। যেমনটা কবির গদ্যে অনেক সময় অনুভূত হয় কবিতার রুমঝুম । ‘কবিতার অতলান্ত’ তাই একটি সন্দর্ভই, যার উদ্দেশ্য নিজেকে খোলা পরিসরে রাখা এবং অন্তটিও খোলা রাখা।
হ্যাঁ, আমি সম্মীলনের কথা বলছি। ভাবনা অসীম, পরিসরটি সসীম। এই অসীম সসীমের লীলাখেলায় সসীমকে অসীমে মিলিয়ে দেবার আর অচেনা অজানা অসীমকে আবিষ্কার করার নেশা শিল্পীমাত্রের। শুধু শিল্পী কেন? বিজ্ঞানী, অংকবিদ, দার্শনিক, ঈশ্বরপ্রেমিক, এমনকি সচেতন সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই একই সন্ধান, একই অনুরণন। অণ্বেষা ও ভ্রমনের লক্ষ্য ও অভিমুখ অভিন্ন, কিন্তু প্রত্যেকটি শিল্পের ক্ষেত্রটি আলাদা। এটা মানুষই করেছে গুণবিচারে, আর সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে। কিন্তু অগ্রসরমানতায় এই সুবিধা আদায়ের বিষয়টি আর স্ট্যাটিক থাকতে পারে না। আর পারে না বলেই আমরা মিলেমিশে যেতে দেখি। আমি কবিতাকারী। কবিতা আমার আবেগ ও উপাসনা। কবিতা করার ক্ষেত্রে নব্যতাই আমার আরাধ্য। সেক্ষেত্রে সাবেকি প্রথাগত ভাষা-শিল্পের তকমাটি আমি কবিতার গলা থেকে খুলে নিতে চাই। শুধু ছবিতে কবিতা, শুধু অংকে কবিতা, শুধু গ্রাফিক্সে কবিতা, এসব আমরা অনেক দিন ধরে দেখে আসছি। আমি চাই আরও সম্ভাবনার জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে এবং সে-সব কিছুর সম্মীলনে নির্মাণ করতে, যখন যেটার প্রয়োজন, সেই নিরিখে। ভাবনাই সেখানে প্রধান, অনুভবই সেখানে আলোড়ন, যার প্রকাশ ঘটাতে লিপি হিসেবে সমস্ত রকমের টুলস্‌ ব্যবহৃত হবে, কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই। এক বন্ধু যথার্থই বলেছে—‘ কবিতা আঁকা হোক, আঁকা লেখা হোক, হোক হোক আরও এসিমিলেশন।’ আরেকটু বলা যাক। প্রশ্ন উঠেছে, ভাষার সঙ্গে এর বিরোধ নিয়ে। আমি বলি, ভাষার সঙ্গে এর কোনোই বিরোধ নেই। নেই ভাষা-কবিতার সঙ্গেও। কারণ এই সম্মীলনের কাজে প্রয়োজনবোধে মুখের ভাষাও ব্যবহৃত হবে। কেউ কেউ জানিয়েছেন ভাষা কি এতই দুর্বল, নিরন্তর ভাষা-চর্চা কি মূল্যহীন, যাতে কবিতা করা যাচ্ছে না? বিষয়টা আমি এভাবে দেখি নি, বা দেখি না। ভাষা কবিতা চলছে চলবেও। তার যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা নিয়েই। তাই বলে এখানেও কি সীমাবদ্ধতা নেই? আছে। চিহ্ন, প্রতী্ক, ছবি, অংক, গ্রাফ, বিজ্ঞান, সবই সসীম। তবু সম্মীলনে পরিধিটা বাড়ে, বাড়ে পরিসরও। আবার ভাষা কবিতায়, সব সময়ই সেই শব্দ বাছা, বাক্যগঠন করা, ভাঙা বা গোটা, বাক্যগঠনে রীতি মানা বা বদল করা, এবং এক বা একাধিক ভাবনাকে চারিয়ে দেওয়া, বা রহস্য ও রিলেট-করাকে পাশাপাশি রাখা এসব চলতেই থাকে। নিরন্তর এই চর্চার একঘেয়েমি থেকে মুক্তি খোঁজার প্রয়াসও এই মিশ্রমাধ্যমের প্রয়োগে সন্দর্ভ নির্মানের প্রচেষ্টা। সীমাবদ্ধতা ও একঘেয়েমি একই সঙ্গে কমবে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু মানব-মনের সমস্ত অবস্থান, দশা এবং রস সে পরিবেশন করে ফেলতে পারবে সে দাবী করা যায় না কোনো মাধ্যমেই। এখানেও না।

অগ্রজ এক কবি খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘চিহ্নের ব্যবহার বোধ করি আমরা দেখেছি ভাষা মানুষের মুখে ফোটার আগে। আজ কি তাহলে আমরা আবার ভাষাহীন মানুষের সেই প্রতীক বা চিহ্নের আশ্রয় নেব?’ আপাতভাবে কথাটা খুবই ঠিক। মানুষ কি ব্যাক করবে? একসময় আকারে ইঙ্গিতে তারা যা বোঝাতে চাইত, পারস্পরিক বক্তব্য ও চাহিদার আদান-প্রদান করত, আজ কি তারই পুনরাবৃত্তি হবে না, কবিতায় এই চিহ্ন প্রতীক ইত্যাদির ব্যবহারে? প্রকৃত প্রস্তাবে, না, তা হবে না। বিষয়টা আজ আর এরকম সরলিকৃত নয়। কেননা, প্রথমত, ভাষা আবিষ্কারের আগে আকারে ইঙ্গিতে যা করা হতো তা মূলত ভাব বিনিময়। আর এখানে যা করার কথা ভাবা হচ্ছে, তা ভাবনার প্রতিফলন। দ্বিতীয়ত, সেই আদি সময়ে প্রাথমিক চাহিদা নির্ভর আকার-ইঙ্গিতে (চিহ্ন বা প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করলেও) নান্দনিকতার কোনো স্থান ছিল না, ছিল নিত্যকার প্রয়োজনীয়তা। এখানে নান্দনিকতার বিষয়টি ভীষণভাবে বিবেচ্য। ভাবনা চারিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সন্দর্ভ নির্মাণের নান্দনিকতা,কবিতা নির্মাণের আকুতি আর বহু পাঠক/দর্শককে এর অঙ্গীভুত করার প্রয়াস। তৃতীয়ত, সে সময়ে প্রয়োজনের ভিত্তিতে তাদের সংখ্যা ও পরিমান ছিল খুবই কম, এবং কিছুটা হলেও স্থুল। আজ সভ্যতার ক্রম-বিকাশের সূত্রে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কারের পথ ধরে তার সংখ্যা ও পরিমান অনেক অনেক বেশি। যেমন চিহ্নের কথা ধরলে, কিছু সাধারণ চিহ্নের কথা বাদ দিলেও অংক-জ্যামিতি ও বিজ্ঞানের নানা শাখায় যে পরিমান চিহ্ন ব্যবহৃত হয়, তা অগুন্তি। এই প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় ভাঁড়ার ভর্তি চিহ্ন অনায়াসে ব্যবহৃত হয়ে ভাবনা প্রতিফলিত করতে পারে তার নান্দনিকতা ও সূক্ষ্মতার দিকটি বজায় রেখেও। চতুর্থত, প্রতীক (Symbol) ভাবনাটি সম্ভবত ভাষা আবিষ্কার ও প্রয়োগ ইত্যাদির পর বা সমসাময়িক। এবং ভাষাও তো মূলত প্রতীকই। পঞ্চমত, ভাষা আবিষ্কারের অনেক পরে লিপির প্রচলন। আর সেই লিপিতেই আমাদের লিপিবদ্ধ করতে হয় কোনো কবিতা বা সন্দর্ভ। লিপির সীমাবদ্ধতা আর ভাষার মানরূপ বিধিবদ্ধ করার কারণে একই ভাষার অনেক কিছুই ফেলনা হয়ে যায়, কোনো মান্যতা পায় না। তৈরি হয় আরও সীমাবদ্ধতা। ফলে আজ এ-সময় ভাষার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনের নিরিখে চিহ্ন ও প্রতীকের ব্যবহার পশ্চাদবর্তী তো করবেই না, বরং সম্ভাবনার দরজা আরও খুলে যাবে। ষষ্ঠত, চিহ্ন ও প্রতীকও মূলত লিপিই। এর বিশেষ দু-তিনটে গুণ হলো ভাষার কাজটিকে সংক্ষেপিত করতে পারে, আন্তর্জাতিক মান্যতা-প্রাপ্ত হলে আন্তর্জাতিকভাবে রিলেট করতে পারে আর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে প্রয়োগের ক্ষেত্রটি যেমন খুশি হতে পারে। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে এর কিছু খামতিও রয়েছে। মূলত এর একমুখীনতা। এই একমুখীনতা অপসারণের দায়িত্ব নিতে হবে কবি বা শিল্পীকেই। সেটাই তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ।

ঠিক এই জায়গাতেই এক অনুজ প্রশ্ন তুলেছেন— সিম্বল-এর প্রয়োগ কবিতার মাল্টি-ডাইমেনশনাল ইন্টারপ্রিটেশনকে কি সীমাবদ্ধ করে ফেলবে না? ঠিক তাই। সিম্বলের একমুখীনতা অনস্বীকার্য। প্রয়োগকর্তা যা রিলেট করতে চাইবেন সিম্বলের মাধ্যমে, যিনি দেখবেন তিনিও তাই রিলেটেড হবেন। এখানে ওপেন স্পেসটি সংকুচিত হয়ে পড়ে। ভাষার মূল উপাদান শব্দ-চিহ্নেরও কিন্তু এই একই অসুবিধা আছে। সংস্কারগতভাবেই হোক আর চিহ্নিতকরণের জন্যই হোক একেকটি শব্দ একেকটি বস্তু এবং ভাবকেই চিহ্নিত করে। কবিতায় এই এক-বগ্‌গা ভাবটি অন্তর্হিত করতে আমরা নানা কৌশল অবলম্বন করে থাকি। সেখানে মূলত শব্দ নির্বাচন তার যথাযথ প্রয়োগে এবং বাক্য গঠনের ভূমিকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং একটি বাক্যের পরবর্তী বাক্য গঠনে ও প্রয়োগে এত পরিসর রাখার ব্যবস্থা থাকে যে সেই একমুখীনতাটা কাটানো যায়। তাছাড়া এক ভাবনা থেকে আরেক ভাবনায় সার্ফ করে চলেও যাওয়া যায়। এক্ষেত্রেও কিছু কৌশল প্রয়োগ প্রয়োজনীয়। এখানেও এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায় চলে যেতে নানারকম টুলসের যে কথা বলা হলো তার যথার্থ প্রয়োগ প্রয়োজন। আর নিরন্তর চর্চার মাধ্যমেও সেসব নয়া নয়া রূপে আবিষ্কৃত হতে পারে। এখানে আমার ভাবনানুসারে কিছু পরিকল্পনা আমি তুলে ধরেছি আমার ‘কবিতার অতলান্ত-এক’ নামক গদ্যে। এখন এসব বাদেও ব্যবহৃত হতে পারে আরও অন্য সব কৌশল, আরও সব পন্থা মূল চিন্তা-চেতনার কথা মাথায় রেখে।

আমার এক প্রিয় অগ্রজ, যিনি একজন চিন্তাবিদও, কবিতাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, জানিয়েছেন, “গদ্যটায় অনেক পসিবিলিটির ইনপুট দিয়েছিস। কিন্তু তর্কগুলো ইন্টিগ্রেট করা মুশকিল।” স্বাভাবিক। যে কোনো এসিমিলেশনে এই অসুবিধাটা প্রকট হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত যদি ভিন্ন আর্ট-ফর্মকে একই পরিসরে নিয়ে আসা হয়। অনেক সম্ভাবনাকে একত্রিত করার এই ‘মুশকিল’টিকেই একটা চ্যালেঞ্জে হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। না-মুমকিন তো নয়। তর্কাতীত হতেই হবে, এমনটা বলছি না। বলছি, তর্কের মধ্যেই সম্ভাবনাগুলিকে একটা পরিসরে এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো যেতে পারে। ফলশ্রুতিতে মিলতে পারে এক নব উন্মেষ, যা এক নতুন পরিসরকে আলোকিত ও বর্ণময় করে তুলতে পারে। তাছাড়া এ-ক্ষেত্রে ভিন্ন আর্ট-ফর্মের মধ্যে অংকন, ফোটোগ্রাফি, ভাষ্কর্য, এবং কিঞ্চিৎ ভাষার কথা ভাবা হয়েছে। আর বাকি যা, চিহ্ন, সিম্বল, গ্রাফ, অংক-জ্যামিতি, বিজ্ঞান, রং, ইত্যাদি সে-অর্থে তথাকথিত কোনো আর্ট-ফর্ম নয়। এ-সবকেই আর্টের আঙিনায় নিয়ে আসাটাই কবিতার অতলান্তের কাজ। অবশ্য উনি এই প্রতিকূলতার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে, এও জানিয়েছেন— “তবে পুরো ব্যাপারটা যে ডিপলি কনসিভ করে সোলো প্রডিউস করেছিস সেজন্য টুপি খুলে রাখলাম। … …। কবিতার এক্সপেরিমেন্টটা চালিয়ে যা।”

আবার এই জায়গাটাতেই এক অনুজ কবি জানিয়েছেন— “কাজগুলো বিক্ষিপ্ত, কেন্দ্রীভূত নয় বা এর কোনো টোটালিটি নেই… …। অনেকটা কোলাজধর্মী।” যদি এ-রকমই হয়ে থাকে, তবে তা আমার ভাবনানুসারীই হয়েছে। কেননা, আমি কবিতায় (যদি সন্দর্ভটিকে কবিতা আখ্যায়িত করি) ‘টোটালিটি’তে বিশ্বাসী নই। টোটাল কবিতা বা নিটোল কবিতা বলে কিছু হতে পারে না বলেই মনে করি। ভাব-ভাবনাকে কেন্দ্রীভূত করতে চাই না আদৌ। বরং চাই কেন্দ্রক ভেঙে অপসারী হোক। কেননা, এই-সময়ের কবিতা আর আজ কেন্দ্রাভিগ নয়, কেন্দ্রাতিগ।  একটি কবিতা অনেক অণু-কবিতার সম্মীলনে। এখানেও কোলাজ-ধর্মীতা তাই স্বাভাবিকভাবেই এসেছে, হয়ত একটা ক্ষীণ রেশম-সূত্র প্রলম্বিত করার প্রয়াসও আছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে হয়ত সেই সূত্রটিকে আমরা গ্রাহ্যেই আনতে পারছি না। ভাষা-কবিতাতেও কি এমনটাই হয় না? ভাষা কবিতাতেও তো আমরা নব নব প্রকল্পের সন্ধান জারি রাখি শুধু মাত্র বহমানতার কথা মাথায় রেখে। যেন স্ট্যাগনেন্ট না হয়ে পড়ে। এখানেও সন্ধান জারি রাখতে হবে। নিয়ে আসতে হবে নানা সম্ভার আর তার প্রয়োগ কৌশল।

অগ্রজ এক কবির প্রশ্ন— “কাল বা সময় সে ভার্সানে কিভাবে অনুভূত বা দৃশ্য হবে?” ( আগের প্রশ্নের রেশ ধরে, চিহ্ন ও সংকেত যদি পশ্চাদবর্তী করে তোলে, তাহলে সেই ভার্সানে)। আগেই বলেছি, আমার বিশ্বাসে আজ, আজকের চিহ্ন ও সংকেতের সঠিক ব্যবহার কবিতাকে বহু অতীতের ভাষাহীন মানুষের দিকে নিয়ে যাবে না। বরং নিত্য-নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত চিহ্ন ও সংকেত (অংক, বিজ্ঞান সহ) এতকাল ধরে অধীত চর্চিত ব্যবহৃত ভাষার পরিবর্ত হিসেবে ব্যবহারে ধার ও ধরতাই বাড়াবে। চিহ্ন ও সংকেতের জন্ম ভাষা-নিরপেক্ষ নয়। সংক্ষেপিত ও নির্দিষ্ট করতে এর জুড়ি নেই। এছাড়া চিহ্ন ও সংকেতের আছে ছবি-ধর্মীতা। ফলে এর একটি দৃশ্যতাও রয়েছে। এই দৃশ্যতা মননে প্রতিফলিত হলে অভিঘাত তৈরি করবে। আমাদের অভিজ্ঞতা ও অধীত জ্ঞানে তার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। স্বাভাবিক কারণেই তার মান ও অভিমুখটির প্রকৃত অবস্থানের প্রেক্ষিতে অনুভব সঞ্চারে সহায়তা করবে।

একটি প্রশ্ন এমন ভাবে উঠেছে, যে, অংক যদি জটিলতার মধ্য থেকে সরলতার দিকে যাত্রার অভিসার হয়, কবিতাও কি তাই? এক কথায় বললে আমি তো মনে করি কবিতার যাত্রা জটিলতায় ভরা আর চেষ্টাটা সরলতার দিকে যাওয়া। আমি কবিতায় ভেদের মধ্যে অভেদের সন্ধানী। এটা ঠিক একটি অংক মূলত সমাধান। কবিতা কোনো সমাধান নয়। আবার অংকের প্রাথমিক অবস্থানটি আপাত সরল, কিন্তু সমাধান যাত্রার পথটি জটিলতায় ভরা। কবিতায় জার্ণিটাও অনেক সময়ই জটিলতায় ভরা। আর সন্দর্ভ হোক বা কবিতাই হোক সে জার্নি এণ্ডলেস। ওপেন এণ্ডেড। তাই সন্দর্ভে অংকের কিছু ব্যবহার চলতে পারে। তাতে জার্ণিটা উপভোগ্য হয়ে উঠতেই পারে।

‘চিহ্ন ও প্রতীকের ব্যবহার কি পাঠকের দিকে তাকিয়ে, রিলেট করার দায় কি কবির?’ এমত প্রশ্নে নানা মুনির নানা মত হতে পারে। কোনো কবি এই দায়টা নিজের কাঁধে বয়ে বেড়ান। আবার অনেক কবি এটা পাঠকের কাছেই ছেড়ে রাখেন। প্রথম ধারার কবিদের ভাবনাটা স্পষ্ট হলেও এই দায় নিতে গিয়ে প্রায়শই তিনি কবিতাহারা হয়ে পড়েন। পাঠককে কিছু বলতে চাওয়াই বড় হয়ে দেখা দেয়। দ্বিতীয় ধারার কবিদের ভাবনাটা এর বিপরীতধর্মী প্রায়। সেখানে তাদের কবিতায় এত স্পেস থাকে, এত বহুমুখীনতা থাকে যে পাঠকালে পাঠকের কাছে তা পুনঃসৃজিত হয়। কবিতাই কবিতার জন্ম দেয়। সন্দর্ভই সন্দর্ভের জন্ম দেয়। যেহেতু পুনঃসৃজনের কথা উঠে আসে, তাই দায়টা পাঠকের কাছেও পুরোপুরি নয়। এমন কি পাঠক/দর্শকেরও কোনো পূর্ব শর্ত থাকতে পারে বলে মনে হয় না। কবিতার উৎস-মুখ থেকে একটা এণ্ডলেস জার্ণি উপভোগ করতে করতে সৃষ্টিকারী কবির যাত্রা, পাঠকের কাছে পুঃসৃজনের মাধ্যমে যে যাত্রা তাতেও সৃষ্টির রস আর আনন্দানুভূতি জেগে উঠলেই একটা পরিক্রমা শেষ হতে পারে। কিন্তু সবসময় পাঠক একই যাত্রায় অভিভূত হবেন তার কোনো মানে নেই। যাত্রাটি সমান্তরাল হতে পারে। হতে পারে আরও অনেক বেশি সম্ভাবনাকে উজ্জীবীত করতে করতে। যেহেতু আমি দ্বিতীয় ধারার চিন্তা-চেতনা বিশ্বাস করি ও পোষণ করি, তাই আমি এখানে অবশ্য করেই বলব, কোনো দায় বা প্রিকনসিভ মনোভাব নিয়ে সৃষ্টিকারী যেমন নির্মাণ করবেন না, তেমনি কোনো পাঠকেরও উচিৎ হবে না কোনো প্রিকনসিভ মনোভাব বা দায় নিয়ে নির্মাণ তথা সন্দর্ভটির রসাস্বাদনে অংশ নেওয়া বা পুনঃসৃজন করা। স্বাভাবিকভাবেই চিহ্ন ও প্রতীকের ব্যবহারে এই নির্মাণ পাঠকের সুবিধার্থে এ-কথা বলা চলে না। কিন্তু পাঠক/দর্শক যদি সহজে রিলেটেড হন, তাহলে তো ভালো কথা। শেষ পর্যন্ত দুই ধারার কবিরাই তো চান তাঁদের সৃষ্টি ও নির্মাণ যেন কোনও না কোনওভাবে পাঠককে ছুঁতে পারে, পাঠককে ভাবাতে পারে, তাকে সমমেলে বাজাতে পারে, সমান্তরাল যাত্রায় সঙ্গী করে নিতে পারে।

লিখেছিলাম বিজ্ঞান বা অংক আমাদের যুক্তিনিষ্ঠ করে তুলতে সাহায্য করে। প্রশ্নটা উঠেছে সেখান থেকেই, যদি যুক্তিনিষ্ঠ করেই, তাহলে প্রান্তিকতার প্রশ্ন আসছে কেন? আর নান্দনিকতাই বা কতটা জরুরি? ঠিকই তো যুক্তি থাকলে প্রান্তিকতা কেন? এখানে প্রান্তিকতার বিষয়টির উত্থাপন করেছিলাম অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বস্তুতঃ বিজ্ঞানের সাধারণ জ্ঞানের বাইরে গেলে, অর্থাৎ প্রয়োগ করলে, বা অংকের সাধারণ অবস্থানের পর আরেকটু উচ্চ-অবস্থানে গেলে, বা প্রয়োগ করলে, সেটা দু-ক্ষেত্রেই, অর্থাৎ প্রয়োগকারি এবং পাঠক-দর্শকের কাছে অন্তরায় হতে পারে। এখানে অধীত জ্ঞানের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতেই হবে। ধারণা আর জ্ঞান এক নয়। তাই প্রান্তিক হতে বাধ্য। একই সঙ্গে এও জানিয়েছিলাম কবিতা কবেই বা প্রান্তিক নয়। এক্ষেত্রে হয়ত আরও প্রান্তিক হয়ে যাবে। কোনো সন্দর্ভের নান্দনিকতা কতটা জরুরি তা নিয়ে বিতর্কের শেষ হতে পারে না। সেটি যদি কবিতা হয় তাহলে আরও হাজার দরজা খুলে যেতে পারে বিতর্কের। আমি বোদ্ধা বা প্রাজ্ঞ কোনোকিছুই নই। সামান্য সাধারণ জ্ঞানে, এভাবে ভাবতে ভালোবাসি। শিল্প মাত্রই নান্দনিকতার আধার। এই নান্দনিকতাকে আনতে বা প্রতিষ্ঠিত করতে নানা শিল্পী নানা উপকরণ অলংকার নানান কৌশল প্রয়োগ করে থাকেন। অনেক সময় কোনো শিল্পী এই প্রচলিত টুলসগুলো (যন্ত্রপাতি অর্থে নয়) ভেঙে ফেলেন, অস্বীকার করেন, নব চেতনায় অন্য কৌশল অন্যান্য উপকরণ অলংকার ইত্যাদির প্রয়োগ করেন। কিন্তু এই ভাঙাভাঙির পরও যা নির্মিত হয় তা নান্দনিক হয়েই ওঠে। অর্থাৎ নান্দনিকতার আপাত মুখটি ভেঙে ফেললেও অন্য আরেকটি নান্দনিকতার মুখ ভেসে ওঠে। যদি তা না হয় তাহলে সম্ভবত তাকে শিল্প বলে চালাতে খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। বিমূর্ততা ও বিনির্মাণের সঙ্গে নান্দনিকতার কোনো দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নেই। এছাড়া নান্দনিকতার কোনো প্যারামিটারও নেই। এটি ভীষণই আপেক্ষিক এবং ব্যষ্টি বিশেষ সাপেক্ষ। নান্দনিকতার চিহ্ন না থাকলে আমরা শেষ পর্যন্ত তাকে শিল্প বলি কি? এখানে আমি যে প্রকল্পের কথা বলতে চাই, তাতেও নিঃসন্দেহে নান্দনিকতার পরশ থাকতেই হবে। সন্দর্ভ নির্মাণের পর যদি তা কাউকেই স্পর্শ করতে না পারে, যদি কারো তন্ত্রীতে টংকার তুলতে ব্যর্থ হয়, যদি অস্ফুটে ‘বা!’ বেরিয়ে না আসে, যদি বিভিন্ন ইন্দ্রিয় সজাগ সচেতন না হয়, যদি মনন অভিঘাতে যথার্থ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে, অর্থাৎ উল্লাস, আনন্দ, দুঃখ, বিষাদ ইত্যাদি মানবমনের নানা অবস্থা ও দশা, তবে সেই সন্দর্ভের অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্য ব্যর্থ বলেই বিবেচিত হবে। 

এক অনুজ কবির প্রশ্ন— এই সমস্ত কাজ কি ভাবনা প্রকাশের এক অনন্য ভঙ্গি যা ভাষাকে অস্বীকার করছে? আরেক অনুজ প্রিয় কবি প্রশ্ন তুলেছে “ ভাষা কী? তার উত্তর যদি এত সংক্ষিপ্ত হয়, তবে গোটা বিংশ শতাব্দীর ভাষা-বিজ্ঞান চর্চা কী?” ইত্যাদি। দুটো প্রশ্নই খুব ভাইটাল। আমার মতো সামান্য এক কলমকারীর গোটা বিষয়টাকে আলোকিত করে তোলা হয়ত সম্ভব হবে না। তবু এ বিষয়ে আমার সামান্যটুকু। প্রথমত জানাই ভাষাকে অস্বীকার করার কথা আমি যেমন ভাবিই নি তেমনি গদ্যে সে কথা বলিনি। বরং ভাষা উচ্চারণের জন্য ধ্বনিগুণের প্রেক্ষিতে কবিতা বা সন্দর্ভের শ্রাব্যতার বিষয়টা যে খুবই গুরত্বপূর্ণ তার  উল্লেখ করেছি। এবং এ-বিষয়ে যে এই প্রকল্পের সীমাবদ্ধতা আছে তারও উল্লেখ করেছি। জানিয়েছি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ নিয়ে আরও ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন আছে। সুতরাং ভাষা অস্বীকারের প্রশ্ন আসে না। কারণ মানুষ ভাবেই মূলত ভাষায়, ছবিতে। এবারে জানাই গদ্যে ভাষা নিয়ে আমার সামান্য কথাবার্তা সত্যি একটি সরলীকৃত রূপে দেখানো হয়েছে, বলা যেতে পারে আমার উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে তার সীমাবদ্ধতার জায়গাটা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে। বিশ্বে এই ভাষা নিয়ে যেমন কাজ হচ্ছে আমাদের বাংলা ভাষা নিয়েও উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ থেকে কিছু কাজ শুরু হয়, যার বিজ্ঞান-ভিত্তিটা তেমন জোরালো ছিল না। কিন্ত বিংশ শতাব্দীতে নানা কবি সাহিত্যিক ও ভাষাবিদের নিরন্তর প্রয়াসে ভাষার একটি বিজ্ঞান-সম্মত মান্যরূপ আমরা পেয়েছি। ওপার বাংলাতেও এ নিয়ে যথেষ্ট কাজ হচ্ছে। যদিও আমি মনে করি বাংলা ভাষায় ভাষা-বিজ্ঞানের ওপর আরও কাজের অবকাশ আছে। প্রসঙ্গত জানাই এই বিষয়ে ১৯৮৭ সালে আমি একটা দীর্ঘ গদ্য লিখেছিলাম ‘বাংলো বাড়ির সংস্কার প্রসঙ্গে’। (বাংলো বাড়ি অর্থে বাংলা ভাষা)। যাক সে কথা। এখানে আমি যেটা এম্ফেসাইজ করতে চাই, তা হলো-- ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে, চিন্তা-চেতনার প্রকাশে শুধুমাত্র ভাষার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, আছে ভিন ভাষা-ভাষির সমস্যা। অনুবাদ প্রায়শই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। নিজের সামান্য কবিতাকারিতে এই অভাব অনেক সময়ই আমার অনুভূত হয়েছে। অনেক সময়ই যা ভেবেছি বা চেতনায় যা ধরা পড়েছে তার প্রকাশে ভাষার অপ্রতুলতা ঘটেছে। ঠিক এই জায়গাতেই আমি আরও অন্য সব কমিউনিকেটিভ মাধ্যম ও চিহ্ন প্রতীক সংকেত ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তার কথা বলছি। যাতে সন্দর্ভটিতে নিজেকে উজাড় করার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধতা কাটে। এছাড়া আমার আরও অনুভব বা চিন্তা যে, অংক ও অংকের চিহ্নও একটি ভাষা, বিজ্ঞানের নানা সূত্র, প্রতীক, চিহ্ন, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদিও ভাষা। আর অনুজ ভাইটি যে কথা বলেছে—“ --ভাষাও তেমনই। জীবের তৈরি করা সিম্বলিক সিস্টেম।” আমি তার সঙ্গে সম্পূ্র্ণ একমত। আর তাতেই সিম্বলের ভাষ্যরূপটির মতো চিত্ররূপটি প্রকল্পে প্রয়োগ করতে অসুবিধা থাকার কথা নয়।

এক বন্ধু কবি ও গদ্যকার, একটি আশংকা প্রকাশ করেছেন— ‘তবে বেশি গণিতদর্শন ঢুকে গেলে তা প্রবন্ধের ধাঁচা থেকে বার করার দায়িত্ব কবির।’ শুধু গণিতদর্শনই কেন? আমি তো কবিতায় যে কোনো দর্শনের ভারের বিপক্ষে। এখানে গণিতের উপস্থিতি শুধুমাত্রই সন্দর্ভটির প্রয়োজনে। এবং আমি আগের গদ্যে জানিয়েছি একটা মধ্য-স্তর পর্যন্ত (সাধারণে অধিগম্য) এর প্রয়োগের কথা। কোনো দর্শনের পাল্লা ভারীর উদ্দেশ্যে নয়। উদ্দেশ্য প্রকল্পের মনোভাবটি যোগ্য সূত্রে, সমীকরণে, স্বীকার্যয়, প্রতিজ্ঞায় প্রতিভাত করতে। এখানে আবার এক অনুজ কবির কথাও একদম ফেলে দেবার নয়। তিনি জানাচ্ছেন, ‘হায়ার ম্যাথমেটিক্স’ নয় কেন? প্রান্তিকতার ভয়ে? বোঝাই যাচ্ছে একদম বিপরীত ভাবনা। শুধু ‘হায়ার ম্যাথমেটিক্স’ই নয় এমনিতেই এক অনুজের অনুযোগ—‘এই নতুন শিল্পকর্মটি আরও প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে না?’ হায়ার ম্যাথমেটিক্স পরিহার করার বিষয়টা আমি তুলেছি, আমার কাছে একটি স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত হিসেবে। নয়ত একদিকে প্রয়োগকারীর সংখ্যা যেমন কমবে, পাঠক-দর্শকও পিছিয়ে যাবে বা এড়িয়ে যাবে। দু-দিকেই কিছু সমস্যার সৃষ্টি হবে। ‘ম্যাথমেটিকাল পোয়েট্রি’তে এসব আকছার ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু আমি যেহেতু সম্মীলনের কথা বলছি, তাই একটা মধ্যপন্থা অবলম্বনই শ্রেয় বলে মনে করি। এছাড়া কবিতা কবে না প্রান্তিক? প্রান্তিকতার ছাপটি এর যাওয়ার কথা নয়। পদ্য (Verse) তবু কিছুটা কম প্রান্তিক। কিন্তু কবিতা যথেষ্টই প্রান্তিক। আর এক্ষেত্রে যদি আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে, তবুও আফশোষ করার মতো কিছু থাকার কথা নয়।

এক অনুজ কবি গল্পকার একদম বিপরীত ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখছেন—‘ কিছু সংকেত আলগা হয়ে থাকে। পুরোটার সাথে সাঁটে না। অক্ষরে লিখিত কবিতার বিকল্প ভাবতে, এই শিল্প-ধরণকে, আমার মন সায় দিচ্ছে না। এই ‘চিহ্ন’ একটা প্রাথমিক বা চিরকালীন বাধা হয়ে দাঁড়ানোর আশংকা থেকে যায়।’ আমি এই ভাবনার সঙ্গে একমত নই। এটা ঠিক, আমার কাজে কিছু সংকেত হয়ত আলগা হয়ে আছে, এবং সেইসব গুলোর পেছেনে যে বিরাট কিছু যুক্তি সাজিয়ে আমি করেছি তাও নয়। ফলে আলগা করে রাখাটা অনেক ক্ষেত্রে হয়ত হয়েছে আমার অগোচরে আবার কোথাও ইচ্ছাকৃত। ঠিক যেমনটা হয় একটা ভাষা-কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রেও। পুরোটার সঙ্গে সাঁটানোর অভিপ্রায় একটা এক-বগ্‌গা ভাব নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সামান্য অতিরিক্ত কিছু অনেক সময়ই অন্য একটা মাত্রা দেয়। এ যেন সেই মহিলা যিনি সমস্ত সাজের পরেও অনেকটা ইচ্ছে করেই মুখমণ্ডলের কোনো এক জায়গার আঁচিলটাকে আরও প্রমিনেন্ট করে তোলেন। কিন্তু পরের কথাগুলো নিয়ে আমার এটুকুই শুধু বলার— কোনো কিছুর বিকল্পই কোনো কিছু হতে পারে না। শিল্প হলে তো আরও নয়। আমি ভাষা কবিতার সীমাবদ্ধতার কথা বলেছি ঠিকই, কিন্তু গোটা ভাষা-ব্যবস্থাকে অস্বীকার করিনি, করা যায়ও না। করবই বা কী করে? অক্ষর আবিষ্কারের পর থেকে  পরাম্পরাটির পথ বেয়ে আজ এই যে অবস্থায় এসেছে, তাকে অস্বীকার করা যায় না। করবই বা কেন? যা করা যায় বা যা করতে চাই, তা হলো এই প্রচলিত অক্ষরমালার মাধ্যমে তৈরি ভাষার বাইরে আরও পসিবিলিটিগুলোকে প্রয়োগ করতে। সেখানে চিহ্ন সংকেত প্রতীক রং গ্রাফ অংক-জ্যামিতি-বিজ্ঞানের টুকরো-টাকরা

একেকটি অক্ষরের মতোই, বা অক্ষরে গড়া শব্দের মতো, বা শব্দে গড়া ভাষার মতোই কাজ করবে, তাদের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে একটি ভাষা যা আজ হয়ত একটু খটমট লাগবে, কিন্তু চর্চায় অভ্যাসে অধিগম্য হবে একসময়। আরেক অনুজ কবি তো আরও নানাবিধ জুড়ে দেওয়ার পক্ষে। যেমন, ডায়েরির পাতা, হিজিবিজি পাণ্ডুলিপি, খবরের কাগজের কাটিং ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেকটা কথাও এখানে বলা দরকার। নিজের কথা, কবিতায় এই বিশ্বপ্রকৃতির, এই নিসর্গের, মানুষের বাইরে আর আর প্রাণীকূলের ভাষা ব্যবহার আর প্রয়োগের কথা ভেবেছি কতকাল, স্বপ্ন দেখি, সেসব তো এইসব চিহ্নে, অক্ষরে সৃষ্ট উচ্চারণ-ধ্বনিতে যদি সামান্যটুকুও প্রকাশ করা যায়। আগের গদ্যে অনুকারমূলক শব্দ ব্যবহারের বিষয়ে বলেছিলাম। এখন তার সঙ্গে যদি এই ধরণের আরও কিছু যোগ করা যায়, তাহলে এগুলো আরও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারবে। শুধুই চিহ্ন প্রয়োগ তো নয়, চিহ্নকে চলমান ও ভাবনার ভাষাময়তায় নিয়ে যেতে আরও সব পন্থা তো রইলই। এসব কারণে চিহ্ন প্রাথমিক বা চিরকালীন বাধা হবে বলে আমি মনে করি না। এই গদ্যে চিহ্ন নিয়ে আরও কিছু কথা আগেই বলেছি। সেগুলোও আমাদের মাথায় রাখা দরকার।

এক বন্ধু যখন লিখছেন— “ভাবনাসূত্র এবং স্রোতকে ফুটিয়ে তুলতে শব্দ রং রেখা ছবি অংক জ্যামিতি সব মিলিয়ে এক ইউনিক উপস্থাপনা”। ঠিক সেখানেই আরেক বন্ধু বলছেন—“শব্দ যে ছবিই আঁকবে তার কোনো মানে নেই। আমরা তো আর ইমেজারি কবিদের যুগে নেই, ছবি আঁকার চেয়ে অনুভব আঁকাই বোধহয় কবিতার বড় কাজ।” ঠিক কথা। আমরা আজ আর চিত্রকল্প তৈরি-করা কবিদের যুগে নেই। (কতটা বাস্তব তা মাপা সম্ভব নয়)। এর বদলে আমরা যদি কল্পচিত্রের যুগেও এসে থাকি (কতজন মাপ করা মুশকিল) তবুও সে আঁকাই। কল্পনা থেকে আঁকা। প্রসারিত চেতনা থেকে আঁকা। অনুভব অভিজ্ঞতাজাত। নিত্য মুহূর্তের অভিজ্ঞতার নির্যাস আঁকা কতটা সম্ভব তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিমূর্তি আর বিনির্মাণের  প্রয়োজন বোধহয় এখানেই। সাধারণভাবে আমরা অনুভব জ্ঞাপন করি। এখন যদি আমার নিজের সন্দেহের বাইরে গিয়েও অনুভবের কথা ভাবি, সেটা প্রকাশ করতেও রং রস রূপ এদের স্মরণাপন্ন হতে হয়। ভাবনা ও ভাষা যেমন ইনসেপারেবল তেমনি অনুভবও ভাবনানুসারী। তাই তাকেও সেপারেট করে রাখা যায় না। অনুভব জ্ঞাপন করতেও আমাদের কিছু না কিছু অবলম্বন করতেই হয়, সে অক্ষরেই হোক আর অন্য কিছুর মিশ্র-মাধ্যমেই হোক। আর আমি এখানে সেই অন্যকিছুর অনেকগুলো অপশনের কথা বলেছি।


এক অনুজ কবি একটা উদাহরণ দিয়ে একটি প্রশ্ন তুলেছেন। কোট করি। “আবার আপনি নিজেই স্বীকার করেছেন কবিতায় শ্রাব্যতার একটা ব্যাপার থাকে। যেমন ধরুণ, একজন কবি লিখলেন—আমাকে দেওয়া হলো (এরপর তিনি একটি ধোঁয়া ওঠা কাপের ছবি বা প্রতীক এঁকে বোঝালেন, গরম চা)। সেক্ষেত্রে তাকে যদি কবিতাটি পাঠ করতে দেওয়া হয় তবে তা কীভাবে করবেন?”। আমার করা কাজগুলো ও গদ্য থেকে আমি সম্ভবত এটা পরিস্কার করতে পারিনি যে এই কাজগুলো বা সন্দর্ভগুলো নিজস্ব দেখার আর পাঠের। কোনো কবি-সভায় এ কাজ পাঠ করে শোনানো বা কমিউনিকেট করার নয়। এ একদমই নিজস্ব তরিকায় দেখা ও পাঠ করা। স্পর্শ করলে ভালো, হৃদয়তন্ত্রীতে টান পড়লে ভালো, কোনো সেনসেশন জাগ্রত হলে ভালো, ভেতরে কিছু স্ফুরিত হলে ভালো, না হলে কিছুই হলো না। আবার সামান্য কিছু হলে, আরেকজনকে ডেকে বলা—এই এটা দ্যাখ আর পড়। এর বেশি কিছু নয়।

এক অনুজ কবি কবিতা নিয়ে তার ভাবনার কথা বলে একটি প্রশ্ন তুলেছে। কোট করা যাক—‘আমার মতে, কবিতার অন্তরঙ্গ শূন্যতা ক্ষয় ও পরিনতিগুলো শব্দের বাঁধুনিতেই ধরা উচিৎ-- যে শব্দের বিন্যাসের ভেতর অন্তর্নিহিত থাকবে অজস্র ছবি এবং সেগুলো পাঠকের ভেতরে ধরা দেবে চিত্রকল্প রূপে। কিন্তু ছবির ভেতরকার গুঞ্জন কি করে টেক্সট ছাড়া বর্ণনা করা সম্ভব? কবিতা তো কবিতাই। আর ছবি হলো ছবি।’ প্রথমত, আমার কাজগুলো আমি টেক্সট হিসবে যে বিবেচনা করি তা আগেই একবার বলেছি। দ্বিতীয়ত, শুধু শব্দ নির্ভর কবিতায় যে ছবি ও চিত্রকল্প ভাষায় তুলে আনা হয় (আমি ‘বর্ণনা’ শব্দটি এড়িয়ে গেলাম) তখন তা যদি একটা টেক্সট হয়, তাহলে ভাষার বদলে বর্ণে, শব্দে, চিহ্নে, সংকেতে, প্রতীকে, গ্রাফে, রঙে, হাইপোথিসিসে, অংক-জ্যমিতি-বিজ্ঞানের টুকরো-টাকরায় টেক্সট হতে অন্তরায় কী? ছবি ইটসেলফ কি একটি টেক্সট নয়, যা অনুভবের অনেক দরজা খুলে দিতে পারে? কবিতার যেমন একটা ছবিধর্মীতা আছে, আমার তো মনে হয় ছবিরও একটি কবিতা-ধর্মীতা রয়েছে। তৃতীয়ত, বর্ণনা্র মাধ্যমে যে টেক্সট নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে তার তরিকাটা এখানে শুধু আলাদা। হয়ে থাকা ছবি থেকে যেমন চিত্রকল্পটি রচিত হয়, তেমনি সম্ভাবনা্র কল্পনায় বা প্রসারিত চেতনায় আঁকা ছবি থেকেও তো কল্পচিত্রটি উঠে আসতে পারে। আর এখানে সেই চিত্রকল্প ও কল্পচিত্রগুলিকে শুধু ভাষা-বর্ণনার বদলে নানা উপকরণে সাজিয়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে। পার্থক্যটুকু আমার চোখে অন্তত শুধুমাত্র এটুকুই।

অনেক অনুজ কবি এই কাজ/সন্দর্ভ/কবিতাগুলোতে অনেক সম্ভাবনা উপলব্ধি করেছেন। নানা প্রশংসাসূচক বাক্যে তারা তাঁদের কথা জানিয়েছেন। সেগুলো এখানে উদ্ধৃত করার প্রয়োজন দেখছি না। কিন্তু সাধারণভাবে উল্লেখ করলে এমন কিছু দাঁড়ায়, যাতে কিছু পরামর্শও আছে। যেমন, ক) এই কাজগুলোতে অপরিসীম সম্ভাবনা আছে। কাজগুলো খুবই ভাবায়। খ) নতুন ভাবনার দিশা দেখতে পেলাম। নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা কবিতায় হওয়া জরুরি। গতানুগতিক ভাবনা থেকে সরে আসতে এই কাজ সহায়তা করতেই পারে। গ) অনেক ছবি ও টেক্সট সহকারে এই ধরণের বাংলায় কাজ প্রথম দেখছি। কবিতার নানা রকম যাপনের ভিতর, এও এক বৈচিত্র মনে হলো। ঘ) কাজগুলো একবারে রিলেট করা একটু শক্ত, কিন্তু একটু গভীরভাবে নিভৃতে দেখলে পড়লে অনুভব করা যায়। আর আজকের শক্ত বা কঠিন আগামীকাল আর নাও থাকতে পারে। ঙ) পড়লাম, দেখলাম এই এক্সপেরিমেন্টাল কাজগুলো। এক্সপেরিয়েন্স করার মতো। পুরো রসদমূলক প্রোজেক্ট ভিত্তিক কাজ। চ) পুরোটা একটা মেনিফেস্ট, পরবর্তী কবিতার। আপনিও সেটা জানেন যে, ওই গদ্যটি পরবর্তী বাংলা কবিতার মেনিফেস্ট। ছ) ইমেজ, প্রতীক, শব্দ-চিহ্ন, রং, লেখচিত্র, অংক, বিজ্ঞান সেন্স নিয়ে একটি কাব্যদর্শনমূলক রচনা। কাজগুলো এককভাবে কবিতার জন্ম দিচ্ছে আমার মধ্যে। জ) বিজ্ঞানবোধ, লজিকাল সেন্স, কবিতা্বোধ থেকে টাইম-স্পেস চেতনাপ্রবাহ কবিতার প্রতি-কবিতার প্রশ্ন জন্ম দিয়েছ। এসব সম্ভাব্য কবিতার জন্ম দিচ্ছে…।  কয়েকটা ইণ্ডিভিজুয়াল পরিসরে এসব কাজ হচ্ছে, তবে এখানে যে অনেক টেকনিক ও নানান মাধ্যমের সম্মিলনের কথা বলা হয়েছে তাতে নতুনত্ব আছে, কিন্তু বড়ই কঠিন কাজ। যার চেষ্টায় আছো, হয়ত সেখানে পৌঁছনই এক অন্য কবিতা। ঝ) কয়েকজন প্রতিটি কাজ ধরে ধরে তার মধ্যে কীরকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, সে কিভাবে দেখছে রিলেটেড হচ্ছে আলোড়িত হচ্ছে তার জানান দিয়েছে। অর্থাৎ পুনঃসৃজনের কাজটি করা। বলা বাহুল্য সেখানে স্বীকার করা হয়েছে কয়েকটা মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে বা এন্টেনায় ধরা পড়েনি বা মনমতো হয়নি। কয়েকজন কয়েকটি নির্বাচিত কাজ নিয়ে কথা বলেছেন। তার ভালো লাগা বা মন্দ লাগা নিয়ে। ঞ) কেউ বলেছেন গানিতিক অভিব্যক্তি, তো কেউ বলেছেন ‘Awesome, magnificecently communicated an abstract art.’। কেউ appreciate করেছেন, the new act of thought and level of imagination which extend the experimental creativities in an unique parameter. ট) এক অনুজ কবি দাবী পেশ করেছেন— এই গ্রাফিক্সগুলো গদ্যের পরিপূরক হোক। কবিতাই হয়ে উঠতে হবে তার কোনো মানে নেই। যেভাবে আসছে সেভাবেই আসুক। হয়ে উঠুক লেখার খেলা। যেগুলো বলা হয়েছে তার থেকেও আরও অনেক বেশি জিনিস আনা হোক। কাগজ-কলম নিয়ে যা খুশি করতে ইচ্ছে করে, তাই আসুক এতে। সাদা-পাতা তো সাদা-পাতাই সই। এসবই আমার পরবর্তী চলার পথের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই যে নানা প্রশ্ন উঠল, ভাবনার বিরোধাভাস দেখা গেলো, বিশ্বাসের পার্থক্য উঠে এলো, অনেক সন্দেহ এবং সংশয় দানা বাঁধলো,  কাজগুলো এবং গদ্যটা নিয়ে, সেগুলো আমার কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আমি চেষ্টাও করেছি সেগুলো নিয়ে আমার বলার কথাগুলো বলতে।

কিন্তু আরও অনেক প্রশ্ন এখনো আলোচনার বাইরে থাকলো, শব্দ (Word) শব্দ (Sound), রেখাচিত্র ধরিয়ে দিয়েই কি বলা যায়, কবিতা হয়ে উঠল? প্রতীক-ভাবনা আর ভাষা-ভাবনার কোনও দ্বৈরথ কি আছে? ভাষা নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কাজের সুফল ও ভাষাশিল্পের কবিতা, সাহিত্য কী কেন, কেন তাতে মিথ্যের আবরণ পরানো হবে? Close ended Text ভার্সেস Open ended text, মিশ্রমাধ্যম, আরও অনেক কিছু নিয়ে এখনও আলোচনার বাকি রইল। একদিকে যেমন এসবগুলি যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ আর আলোচনার দাবী রাখে অন্যদিকে আরও যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে পুনঃসৃজনের তার উল্লেখ সহ আমার কথাও জরুরি। সেগুলি এর পরের ধাপে নিশ্চয়ই নিয়ে বসব। কয়েকটি প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা যেমন বাকি রইল তেমনি কিছু প্রতিক্রিয়া আসবে আসবে করেও শেষ পর্যন্ত এখনো এসে আমার কাছে পৌঁছুলো না। আশা করব সেগুলোও এর মধ্যে এসে যাবে। তখন সব মিলিয়ে আবার একটি গদ্যে হাত দেওয়া যাবে। শেষে একটা কথাই বলব, আমার জ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা হয়ত সবকিছুকে প্রাঞ্জল করে তুলতে পারছে না, কিন্তু আমার বিশ্বাসের জায়গাটা তাতে এই মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে না। নানাবিধ ইনপুট সম্মীলনের মাধ্যমে যে মিশ্রমাধ্যমটি সৃষ্টি হবে, তাতে সন্দর্ভ নির্মাণ করা শুধু সম্ভবই না, তা সুকুমার শিল্পের পর্যায়েই পড়বে। ভাষা-কবিতার বিকল্প না হলেও তার সম্পূরক হতে বাধা দেখি না । এও ঠিক, সন্দর্ভটি এইরকম নানা ভূষণে এককভাবে বা কয়েকটির সম্মীলনে ভূষিত হয়ে, আবরণ পরিয়ে যেমন তেমনি আবরণ উন্মোচিত করেও, আর ভিন্ন মাধ্যমে ভ্রমণের সুবিধেটি নিয়ে কবিতা হয়ে উঠতে পারে কোনো পূর্ব শর্ত ছাড়াই।         

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments