অনুপম মণ্ডল



অনুপম মণ্ডলের কবিতা


অহম ও অশ্রুমঞ্জরী



৭ 
এই তোমার অসীমের পথ। একটা ডাহুক কোথাও ডেকে উঠলো শিরিষের ছায়ার ভেতরে। যেন সীমাহীন জলের তাপে ক্ষয়ে যাওয়া এই কালচক্র, নিরুদ্ধ পথের বার্তা, সুর খুঁজে, নিভৃতে আমার শ্রান্ত প্রানের প’রে তুলে ধরল অপার নিদ্রার মোহ।




ব্রহ্ম থেকে তাকে দেখি তৃণ অব্দি, ধুলাচ্ছন্ন, কেশরাশির স্তব্ধতায়। আমাদের দিনমান কেটেছে মৃতের অনুসন্ধান করে। সূর্যাস্তের কিছু পরে, হিজলের ক্ষয়ে যাওয়া মেঘ ভরা বিশাল পাতাটির তলে হাত জোড় করে দাঁড়ালাম। ললাটদেশ থেকে একে একে মুছে ফেললাম ব্যাথার ধ্বনিগুলো। দেখলাম ছায়াহীন জ্যোৎস্নালোকে একটা ডাহুক, পশ্চিম আকাশের পানে উড়ে যাচ্ছে।



মাথা কিছুটা নিচু করে সন্ধ্যার কাছে এসে দাঁড়ালাম। পাতা উড়ছে। করবীর শীর্ণ পাতাটি মৃত্তিকার পানে যেতে যেতে আরো রক্তিম হয়ে উঠছে। যে স্বর, অনন্তের কাল ছিঁড়ে ভেসে আসছে, পিতৃঋণ থেকে, তাহার পানে তলিয়ে যাচ্ছে ওই রথারূঢ় রমণীসকল। শরীরশোভা। আকাশের নিম্নভাগে ঊর্ধ্বকরে স্থিত ওই পৃথিবী।


১০
ঝাপটানো নিনাদের ওপর আশ্রিত তার কণ্ঠস্বর। আর অল্প কিছু তুষারের কণা, এইখানে ইতস্তত লেগে রয়েছে। বাতাসে দোলা কোন গাছে। কারো উলের খেলনার পাশে, বিকেলের শেষ আলো এসে ভাঙছে। গোধূলির ওই শুভ্র পালকগুলো তলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। জোনাকিদের গানের গভীরে।


১১
তৃণভক্ষণের কাল অভিমুখে আমাদের যাত্রা। ঘন নীল দিগন্তে, বাঁশ বনের মাথায় অপার  সবুজের মধ্যে বৃষ্টি এলো। রাজগিরির পাহাড়ে তখনও অস্তগামী সূর্যের শোভা। যে সন্ধ্যা এক দিন অন্তরতম ছিল জীবনে। আরেকবার মৃত্যুহীন পেলাম তাকে। নিদ্রার আয়োজন থেকে কিছু দূরে, শূন্য পথের পরে ঝরে পড়া অসীমের সুরে।   


১২ 
একটি মানুষ যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেইখান থেকে তাকে তুলে ধর। একটি দিনের ক্ষুধায়। দেখ আমাদের ক্রন্দনের অবসরে তবু মেঘ ওড়ে। মেঘের অঞ্চল থেকে দেখা যায় মেঘদের ওড়া। যেন শূন্য চরণমূল সাথে করে সকল যাত্রী চলে গেছে আর ওই গৃহপ্রদীপের প্রসারতা তারা লক্ষ্য করেনি। গলে ওঠা কোন বিভার তলে ঝুলে আছে যেন কার অরুণরথ। 


১৩ 
এই উন্মুক্ত শ্মশান ভূমি; গম্ভীর নিনাদি কোন ঝরনার স্তূপ হতে, পিতৃলোক, মোহনিদ্রার পানে জাগ্রত। কত পুঁথি, অর্ধসুপ্ত আঁখির জাগরণ, এইভাবে শীতের শেষে ঝরে গেছে। মরনাহত আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে তখনো রাত্রি শেষের অলস অন্ধকার। এক করুণাময়ীর শাসনের ধ্বনি দূর হতে দূরে, মিলিয়ে যেতে যেতে, ওই মেঘের গায়ে গিয়ে ঠেকেছে। আকাশ পথে।



১৪ 
না আহার না নিদ্রায়; ঝুড়ি হাতে, বক্ষোদুয়ার থেকে কেউ বাড়ি ফিরছে। যেন গমনোদ্যত তার জীবনপথে দরিদ্র পিতার প্রবঞ্চনা। একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকছে। কোথায়, কোন মায়াময় বনপ্রান্ত, ভরে আছে শন শন শব্দে। এই মাঠের, এই শীর্ণ পথ ধরে যারা ফিরেছে সন্ধ্যার কিছু আগে। তাদের মাথার উপর ছায়াভরা অসীম আকাশ। একটা সুর, ঘনায়মান গম্ভীর নির্জনতার মধ্যেও অন্ধকারে জড়িয়ে রয়েছে।

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments