অহনা সরকার


 

অহনা সরকারের গদ্য

ঘটমান শব্দযোগ



"আমি তোমাকে আমার মধ্যে দেখতে চাই"। দু'জন বা একাধিক বা অনধিক মানুষ নিজেকে বা একে অন্যকে প্রায়ই বলে থাকে। কিন্তু আমি কেন আমাকে অন্য কারোর মধ্যে দেখতে চাই? কেন খোঁজা সেই দেখা যা আমার নিজের কাছে স্পষ্ট নয়। অন্য কেউ আকারে এলেই সেটা হবে! 

"কবিতা বিষয়ক গদ্য" এটা নিয়ে লিখতে গিয়ে এমন অদ্ভুত ভাবে শুরু করা! কিন্তু শব্দ কি? কোথা থেকে আসে সে? সেটাই তো একটা বানানবোধে একসময় উচ্চারণগত পার্থক্যে "কবিতা", "গদ্য" আরো আরো যা নাম সেগুলো ভূষিত হয়। জানি না! আমার সেটাই মনে হয় বা বলা যায় এই বিষয় নিয়ে লিখতে হবে জানার পর একটু আধটু যা পড়েছি, পড়ার চেষ্টা করেছি তার থেকে সেটাই মনে হয়েছে। আমার দেখা আমাকে আর আমার দেখা আমি, দুটো কখনই এক নয়। আর এক নয় বলেই হাঁটতে হাঁটতে একসময় পায়ের নিচে ধূলো বালিদের দিকে তাকিয়ে জানতে ইচ্ছে করে, "কিরে এতক্ষণ খালি পায়ে আসছিস! তোদের বুঝি 'জুতো আবিষ্কারের' গল্প পড়ানো হয়নি স্কুলে"?

এই যে ঘটমান শব্দযোগ। কিভাবে জানলাম! আগে কোন একটা সময় আমি ভাবতাম শব্দরা আসে, থাকে কোথাও একটা! আমারই মধ্যে। মাঝে মাঝে যখন কিচ্ছু লেখা হয় না, তখন পড়তাম। মনে হত ভেতরের সব শব্দ শেষ হয়ে গেছে। এই যে পড়ছি শব্দ স্টোর হচ্ছে, আবার লিখতে পারব। অ্যাকচুয়ালি হতই তাই। বেশ টানা কিছু দিনপড়ার পর, আবার তারা কথা বলতে পারত। আবার লেখা। কিন্তু ওই যে বললাম, পায়ের নিচে লেগে থাকা বালি, জুতোর শব্দ, প্রজাপতির সর্দি, মাছেদের মন খারাপ তারা কেন আমার সাথেই কথা বলতে আসছে বা আমি কেন হাঁটছি হঠাৎ সেখান দিয়ে, আর তাই দেখতে পারছি, রাত আসলে রোজই দাঁড়ায় শহরে, শুধু মাত্র কোন কোন দিন সে "এসপ্ল্যানেডে’র রাত" হয়, অক্ষরপরিচয় ঘটবে বলে, আমারই! যে ঘর আমার নিখোঁজ তার জানলায় দাঁড়িয়ে অনেক অনেক দূরেরর একটা আলো, লোনতা ঢেউ চোখ মুখে এসে লাগছে। নীল স্তব্ধবাক্ আর শঙ্খচিলের মাঝে মাঝে চিৎকার। অনেকক্ষণ পর, জুম কমাতে কমাতে দেখা যায়, একটা দেওয়াল, ভাসানো জাহাজের ছবি। সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে নির্বাক শুনছে সেই শব্দযুগল। আঙুল জন্ম দিচ্ছে প্রাণ। হাতে হাত ধরে থামতে থামতে খুঁজে চলা।



আমার দেখায়, দেখারা


১.


"কিছু খোলা পিঠ, না আঁচনাড়ো চুল আর উদভ্রান্ত আমরা।
শুরুর পর লাইন থেমেছে সার বেঁধেই। বন্দর পাড়ে অনেক অনেক বিদেশি জাহাজ। সূয়েজ বা জিব্রাটোল। গাড়ি বারান্দার কাঁচে একটাই মুখ আধখানা নেভা জ্বলা কারখানায় এইমাত্র চাপা পড়লো সদ্য জীবন কাটিয়ে ফেরা সুসংবাদ!

একটা করাত কলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ও! না না কাঠ চেরাইয়ের। একটানা ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ শব্দ আর জলা জমায় নীল ফ্যাকাশে ব্যাঙের ছাতা কেমন যেন আড়ষ্ট! হাতে নাকি নক্সা বেরোয় ওদের ছুঁলে! মা বলত! ঝাপসাঘরে, শুধু কয়েকটা আলো যেন জাপানি টিউবের মতোন এমাথা থেকে ওমাথা ছুটে বেড়াচ্ছে! হঠাৎ করেই! বালিতে ডোবানো অবয়বের একাংশ আর নিচে লেখা, "সেদিন এখানে জাহাজডুবি ঘটেছিল"!

জাহাজডুবি কেন হয়? বা জাহাজ ডোবে বলেই জানা হয়, হলুদ, নীল ধূসর, কাঁটাগাছের গায়ে আলরঙা মেঘ। কখনও সমুদ্র ডুবতে যায় নিজেই। একটা ছবি যখন হাঁটতে হাঁটতে জুতো মোজা খুলে নরম ঘাসে শব্দ! কোথা থেকে আসছে সে? কেনই বা আমার আঙুলে তারা নিঃশব্দ চাইছে! কেনই বা নিঃস্ব?

এই লেখাটা, সেদিন লিখেছিলাম, যেদিন প্রথম জানলাম কবিতায় গদ্য লিখতে হবে! বা উৎসে দাঁড়িয়ে নদীর সাগরায়ন। কবিতা বা যা লিখছি, তা কোথা থেকে আসে! কেন হঠাৎ জনবহুল ট্রাম লাইনের পাড়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্র ডোবে জাহাজঘাটে? হাঁটতে হাঁটতে চলা পথ আঙুলে রেখে, তার প্রতিটা ছোঁয়ায় নিজেকে দেখা। আর সেই দেখা স্পষ্ট করা "শব্দে"। 

এই লেখাটা আসলে একদম শেষ লাইনে দাঁড়িয়ে। একটা বইয়ের পাতা, সাদা’র ওপর বালি, একটা জাহাজ ডুবে আছে। ওপরে লেখা, "আমাদের পথে এককালে জাহাজডুবি হতো!!”
সেদিন কোন কারণে ট্রেন আসছিল না, কোথাও অবরোধ বা কিছু একটা ছিল। একটা ঝাঁকা ট্রেন লাইনের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল, পাশেই একটা শিরিষ গাছ আছে, জাস্ট গুণে গুণে ৫টা মাত্র পাতা তখন সারা গাছটাতে। ঝাঁকাটা যেন নিজের পিঠ খুলে দাঁড়িয়েছে আর হাওয়ায় লন্ডভন্ড শিরিষ জ্বর সারিয়ে ওঠা চুলের মতো অস্বস্ত্বি, ইতস্তত ভাব নিয়ে! 

এখানের রেল লাইনগুলো ওত কাটাকুটির নয়। একটার গায়ে অন্যটা থেমেই পাশ দিয়ে চলে গেছে সারি। যেন কোন অজেনা শহর। কয়েকটা জাহাজ দাঁড়িয়ে, ওই সুরকিগুলো আর কি! কেমন কালো, ত্রেকোণা, নানা রঙের আকার হয় না! উল্টো দিকের রাস্তায় তখন বৃষ্টি পড়ছিল! মানে শরৎ সত্যিই! গাড়ির কাঁচে মুখটা দেখা যাচ্ছে পুরোটাই, কিন্তু স্পষ্ট আসলে ১টা অর্ধেক! আজকে বাড়ি যেতে হবে না। দুটো স্কুলফেরতা পুঁচকে তখন ফিরছে। কোন কারখানায় বিকেলের সাইরেন তখনই। কাজে যাওয়া মানুষদের ছুটি শেষ আর ছুটিদের জীবন শুরু! যেমন স্কুল থেকে ফিরতি সময় বা কারখানার বন্ধ গেট পেরোনো সাইকেল! নতুন করে আলো জ্বলবে এবার, হাতুড়ি শব্দে চাপা পড়ে সারাদিনের বিশ্রাম-শ্বাস! সেও তো জীবন নাকি!

কারোর সাইকেলের চেন পড়েছে। ও না! ভ্যানের। হাত দিয়ে যখন স্কোপ গুলো ঘোরানো হচ্ছিল ঠিক যেন কয়েকটা কাঠ একটা করাতকে কাটছে। মানে করাত কাঠ কাটে আর কাঠে কাটা পড়ে করাত দুটোই তো একই মনে হয় আমার! শুধু শব্দগত শোনায় যে ময়লাগুলো এই বর্ষায় জমা জলের পাশে ফেলা, সেখানেই ব্যাঙদের ঘরবাড়ি! ছাতা আড়ষ্ট মুখে দাঁড়িয়ে! কারণ ব্যাঙ সেখানে কখনও আসে না! মেঘলাকালে সূর্য নেভার সময় চারদিকটা ঘষা কাঁচের মতো লাগে! জমা বাষ্প জলকে আলাদা করতে ছাড়িয়ে নিচ্ছে হাত! সেই সময় শেষ আলো খুব তাড়াতাড়ি যেন আজান মিস মানে আজ প্রচুর বকুনি আছে বাড়িতে! এমন স্পিডে দৌড় লাগায়। হঠাৎ করেই ধূ ধূ অন্ধকার! আর যেই মাত্র অন্ধকার হল, সামনে ওই ছবিটা দেখলাম, আর লাইনগুলো "কোট" পরে নিজেকে এখানে রাখা! তবে সত্যিই জাহাজডুবি কেন হয়? আমি কখনও জাহাজে চড়িনি। চড়ার চান্সও বড়ই কম! তবে উড়ো জাহাজ সেই সময় ঠিক মাথার ওপর দিয়ে নামছিল একটা! শেষ আলোয় হলুদ ফণিমণসা, ছড়ানো ছিটানো মেঘ। নীল শূন্য ডুবে যাচ্ছে নিজেই।



২.

"ছুঁতে চাই অথচ!” কাল ভোর রাতে, তখন ১০ টার কাঁটা আচমকাই থেমেছে চারের ঘরে। কোণাকুণি একটা মাকড়সা অন্যমনস্কের মতো নখ অথবা হাত খুঁটে সরিয়ে রাখছে কিছু নির্বিচার। এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে!
রোদ পড়ার আগেই রোজ ডুবে যায় রূপনারায়ণ, ফাঁকা ট্রেন, গদি আঁটা চেয়ার ভাবতে ভাবতে একসময় রান্নাঘরের শিকলশব্দ! বহুদিন আগে পাড় ধরে একবার হেঁটেছিলাম। তারপর তুমি চলে গেছ!
শুধু ডাকনামটা পড়ে আছে। অচেনা খাতা দেখায় এভাবেই।
অঙ্কের যুক্তাক্ষর, কাঁচাকুচি রোদে মতোনের সব যত্নীশ"

ওপরের লেখা লাইনগুলো, প্রতিটা কোন না কোন সুরকির আধভাঙ্গা মাটিদেওয়াল, আঙুলছুঁয়ে! আমার খাটের পাশেই একটা বন্ধ জানলা আছে। সমস্ত সময় বন্ধ থাকে। অদ্ভুত হচ্ছে, ভাঁজ হয়ে থাকা আলোগুলো ওখানে যখন পড়ে, ঠিক মনে হয়, ঘড়ির বন্ধ কাঁটা একা একা মাথা নিচু করে বোধহয় কোন কার্ণিশ খুঁজছে! খোলা আকাশেরও তো কিণারা থাকে! যারপর শূন্যকে আর নীল মনে হয় না! রোজ ট্রেন জানলার ডানদিকে পড়ে রূপনারায়ণ। সকালে তার চোখ স্পষ্ট জলে ছলছল, সন্ধ্যে হতেই গাঢ় গমসকাল তার গায়ে যেন আঁচড়ে আঁচড়ে আদর রেখেছে কোন প্রিয়তমা। ট্রেনগুলো খুব স্পিডে যায় এ রাস্তা দিয়ে। কামরার হাতলের সাথে লেগে থাকা ঝুলন্ত দোল! খড়ড়ড়, ঝনঝন, ঝকাৎ ঝকাৎ! অদ্ভুত কথায় সাড়া রাখে! যেন না পসন্দ কোন মত কেউ সাড়ায় জানাচ্ছে! রান্নাঘরের শিকল নাড়িয়ে! শরৎ রচনাবলীতে পড়েছিলাম! 

অনেকদিন আগে আমার বাবার সাথে কোন নদীর তীরে হেঁটেছিলাম। প্রথমবছর যতটা কাছে ছিল! পরের বার আরো অনেকবেশী দূরে তখন, ওপারের পাড় ভেঙ্গে। যেন খুব চেনা কেউ। এই তো কদিন আগেই নতুন কোন নাম দিয়ে ডাকত! আজ শুধু ওই নদী হেঁটে যাবার পায়ের ছাপটা পড়ে আছে ডাকনামের পাশে! যে সমস্ত সময় বা শুধু সাদা পাতা কখনও পরে লিখব বলে রেখে দেওয়া, সেগুলো রোদ হাওয়া না পেতে পেতে হলুদ হয়েছে! ওপরে ১ মাঝে একটা লাইন, তার নিচে আরো কোন সংখ্যা! অক্ষরের সাথে যুক্ত যোগ নিজেই! একজন জাদুকর! যেন খুব যত্ন নিয়ে এই ধূলো ময়লা রোদকে কেচে পরিষ্কার করে মেলে দিয়েছে! দেখে মনে হচ্ছে! আরে! এটা তো রোদেরই মতোন সেই!


অনেক পরে হাতড়ে খুঁজে আরো হয়ত অনেক চেয়ার এপাশ ওপাশ করে জানতে পেরেছিলাম, আমার সবচেয়ে প্রিয়তম কবিতা সুকুমার রায়ের "শব্দ কল্প দ্রুম!”  ছোট বেলায় চেনা কথাগুলোই অদ্ভুত উচ্চারণে পড়তে ভাল লাগত। একটা সময় পর্যন্ত, এটাই দর্শন ছিল এই লেখাটার প্রতি। শব্দ, খুলে মেলে এলোমেলো বা পরিপাটি করে দেখলে, "ঠাস ঠাস দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খটকা-/ ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা!" চাঁদ ওঠে সূর্য ডোবে, রাত কাটে কিন্তু রক্ত দেখতে পাইনা তো! কেন পাইনা! নিশ্চই পড়ে রক্ত। আমি পাই না কারণ আমি দেখতে হয়ত শিখিইনি। এভাবে লাইনের মধ্যে চলতে চলতে, কোন এক রাতের খোলা, মানুষে মানুষে তার সমস্ত বয়ে মাড়িয়ে পিষে আদরে! কিন্তু সাজানো শুধু উপমায়!

আমার দেখা, না দেখা, না দেখতে শেখা বা পারা। যেগুলো এখনও হাত ধরার অপেক্ষায় থেমে বা! এই যে এখন প্রচন্ড বর্ষাকাল। পাশের ড্রেনে ব্যাঙগুলো জেগে পার্টিমত্ত! "ওইইইই ঘুমাতে দে না"! বলতেই একসাথে সবকটা থেমে গেল! আমার মনে হল! বা! আমার কথা বুঝল তো!  যদিও পরক্ষণেই আবার শুরু! তাও! শব্দবোধের এ রচনা, এটাই তো বোধহয় লেখা! এভাবেই তো বহমান সৃষ্টির আলেখ! কাঁটা ঝোপ আর কাটা! শুধু একটা চন্দ্রবিন্দুর প্রভেদ! তবে চন্দ্রবিন্দু বড় ভাল গান করে! স্পেশালি উপল!





1 comment:

  1. চলতে চলতে কথা বলে যাচ্ছে শুকতারা

    ReplyDelete

Facebook Comments